এই বার মৃদু ও সাধারণ মনের রোগের কথা বলা যাক। এই সব রোগকে ইংরাজিতে নিউরোসিস এবং বাংলায় উদ্বায়ু বলা হয়। এই সব রোগী আর পাঁচ জনের সঙ্গে মিশে থাকতে পারে, কাজকর্ম করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালাতে পারে এবং আগের দুই প্রধান রোগীদের মতো জীবন বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। তা বলে চিকিত্সার ব্যাপারে পরিশ্রম বা সময় কম লাগে তা মনে করা উচিত নয়। এরা নিজেরাই তাদের রোগ সম্পর্কে সচেতন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা সুস্থ মানসিকতা ফিরে পেতে চায়। এই রোগে ভুগছে, খুব কম করে ধরলেও শতকরা প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি জন। যেমন, একটি নিউরোসিস হল অবসেশিভ কমপালসিভ বা নিউরোসিস বা পীড়নকর আবেগগ্রস্ত অবস্থা। তেমনি আছে হিস্টিরিয়া, উত্কণ্ঠিত বা আতঙ্কিত অবস্থা (anxiety state) ইত্যাদি।
প্রথমোক্তটিকে সংক্ষেপে আমরা অবসেশন বা আচ্ছন্ন অবস্থা বলে থাকি। আপনারা সকলে শুচিবায়ু কথাটি জানেন এবং শুচিবায়ুগ্রস্ত কথাটি শুনলেই আপনাদের চোখের সামনে যে ছবিটি ভেসে উঠবে সেটা এই রকম — সাধারণত মধ্যবয়সি কোনও মহিলা বারবার হাত ধুচ্ছেন সাবান দিয়ে, স্নানাগারে গিয়ে এক ঘণ্টা থেকে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছেন, ধমকধামক, হিতোপদেশে কোনও কাজ হচ্ছে না, বাড়ির সকলেই তাঁকে নিয়ে মুশকিলে পড়েছেন। শেক্সপিয়রের লেডি ম্যাকবেথের কথাও আপনাদের মনে পড়তে পারে। তিনি হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তখন তাঁর হাতে রক্তের দাগ নেই, কিন্তু অপরাধবোধ তাঁর মনকে আবেশিত বা আচ্ছন্ন করেছে এবং তিনি বারবার হাত ধুতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের রোগীদের সকলেই যে অতীতের কোনও অপরাধমূলক কাজের জন্য এই বাধ্যকারী শক্তির দ্বারা তাড়িত হচ্ছেন তা নয়। অনেক সময় অতীতের কোনও তুচ্ছ ঘটনা যা তার বা চিকিত্সকের নজর এড়িয়ে গেছে এবং যার জন্য রোগী সচেতন ভাবে অপরাধ বোধে ভুগছে — এই আচ্ছন্ন অবস্থার জন্য দায়ী হতে পারে।
এই অবস্থায় শারীরবৃত্তিক বিকারতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন রুশ বিজ্ঞানী পাভলভ। ল্যাবরেটরিতে ছোট এবং বড় প্রাণীর উপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যে কোনও সংকটজনক অবস্থায় প্রাণীটিকে রেখে দিলে এই আচ্ছন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন, একটি বাচ্চা কুকুরকে একটা উঁচু টুলের উপর দাঁড় করিয়ে যদি টুলটিকে ধীরে ধীরে এক পাশে কাত করা যায় তা হলে পড়ে যাওয়ার ভয়ে কুকুরটি আর্তস্বরে চিত্কার করতে থাকবে এবং নখ দিয়ে টুলটিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবে। এই রকম পরীক্ষা কয়েক বার করার পর ওই রকম উঁচু টুলে উঠিয়ে দিয়ে টুলটি নাড়ালেও কুকুরটি ভয় পাবে, ডাকতে থাকবে এবং নখ দিয়ে টুলটিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবে। আত্মরক্ষামূলক প্রবৃত্তি থেকে তার মধ্যে এই আচ্ছন্নতা রোগের সৃষ্টি হয়েছে; আত্মরক্ষা প্রবৃত্তিমূলক নতুন শর্তাধীন পরাবর্ত গঠিত হয়েছে। পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য ছোটবেলা থেকে যদি কোনও বালক বা বালিকাকে ময়লা লাগলে বকুনি দেওয়া হয় বা নির্যাতন করা হয়, তবে তার মধ্যে এই শুচিবায়ু, চলিত কথায় (washing mania) অভ্যাসটি গড়ে উঠতে পারে। অবশ্য যদি রোগী নিস্তেজনাধর্মী মস্তিষ্কের অধিকারী হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/21/2020