সাধারণ মানুষ দ্বয়বাদী ধারণাপুষ্ট, দেহ-মন সমান্তরালবাদ তাদের কাছে খুব সহজেই গ্রহণীয় এবং বোধগম্য। দেহ এবং মন আলাদা কিন্তু পরস্পরকে সমান্তরাল ভাবে প্রভাবিত করে, এই প্রচলিত ধারণাকে আরও পরিপুষ্ট করেছেন আধুনিক কালের চিকিত্সকরা। তাঁরা ট্রাঙ্কুলাইজার, অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট এবং অন্যান্য মস্তিষ্ক প্রভাবকারী ওষুধ ব্যবহার করছেন, আবার ফল না পেলে রোগীকে মনের চিকিত্সার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে পাঠাচ্ছেন। এই চিকিত্সা কিছু দিন আগেও পুরোপুরি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতিতে আমাদের এখানে প্রচলিত ছিল।
আমাদের জড়বাদী বা ভাববাদী, এই দুই ধারণারই বিরোধী। মনকে বস্তুত মনে করা যায় না, আবার মনকে মস্তিষ্ক নামক বস্তুর প্রভাব থেকে মুক্ত বলে ভাবাও চলে না। মস্তিষ্কই মন ও মানসিকতার অধঃস্তর (infrastructure)। মস্তিষ্কের উত্তেজনা, নিস্তেজনা, গতিময়তা মন এবং দেহে নানা ভাবে অভিব্যক্ত। যেমন, মস্তিষ্কের উত্তেজনা প্রবাহের অকস্মাৎ আধিক্যে এক দিকে মনে প্রক্ষোভের সঞ্চার হয়, অন্য দিকে অঙ্গ সঞ্চালন ইত্যাদির দ্বারা সেই প্রক্ষোভ প্রকাশের চেষ্টা দেখা যায়। মস্তিষ্কে নিস্তেজনার আধিক্য ঘটলে ওই ভাবেই সেটা প্রকাশ পাবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, ব্যক্তি যেমন বিভিন্ন, মনও তেমনি ব্যক্তি বিশেষে স্বতন্ত্র। তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য, মস্তিষ্কর টাইপ এবং পরিবেশ প্রভাবে গঠিত শর্তাধীন পরাবর্ত ইত্যাদির ঘাত প্রতিঘাতে গড়ে ওঠে মানসিকতা। এই সবের ওপরেই বর্তমান মস্তিষ্কর উত্তেজনা-নিস্তেজনা আর তার প্রতিক্রিয়া নির্ভরশীল।
একই উদ্দীপক বিভিন্ন মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে। যে কথায় এক জন ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে পারে, সেই কথাতেই অপর এক জন মৃদু্ হাসির সঙ্গে প্রতিপক্ষের ক্রোধকে অনায়াসে প্রশমিত করতে পারে।
এতক্ষণ আমরা যা বললাম তা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মনোরোগ সম্পর্কে চিকিত্সকদের যদি একটি সর্বজনগ্রাহ্য তত্ত্ব থাকতো এবং মন ও মানসিকতার বিভিন্নতা ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতো তা হলে সাধারণ মানুষ মধ্যযুগীয় ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে পারতো। অবশ্য সংস্কৃতির বিভিন্নতা এবং সাধারণ অজ্ঞতা — যার উল্লেখ প্রথমেই করা হয়েছে — সেগুলো বোধ হয় থেকেই যেত।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/2/2020