মস্তিষ্ককোষের অন্যতম ধর্ম গতিময়তা সম্পর্কে কিছু না বললে স্কিজোফ্রেনিয়ার প্যাথোফিজিওলজি বা মস্তিষ্কধর্মজনিত প্রক্রিয়া বুঝতে আমাদের অসুবিধা হবে। গতিময়তা উত্তেজনা নিস্তেজনার মতোই মস্তিষ্ককোষের আর একটি বিশেষ ধর্ম। বাইরের বা শরীরের ভিতরের উদ্দীপক মস্তিষ্ককোষে যে উদ্দীপনার সঞ্চার করে তার গতিবেগ সব মস্তিষ্কে এক রকম নয়। এই গতিময়তার সঙ্গে মস্তিষ্কর টাইপেরও একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে, অতি সংক্ষেপে সেটা উল্লেখ করছি। উত্তেজনা নিস্তেজনা, যে সব মস্তিষ্কে সমমাত্রিক, তাদের আবার এই গতিময়তার মাত্রা অনুযায়ী দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। যাদের গতিময়তা বেশি তারা চটপট অন্যের বক্তব্য বুঝতে পারে এবং অতি সহজেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে পারে। এই টাইপের নাম প্রাণচঞ্চল বা স্যাংগুইনাস (sanguineous)! আর গতির বেগ যাদের মধ্যে কম, কোনও কিছু শুনলে বা পড়লে তারা বুঝতে বেশি সময় নেয়; সব কিছু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। এক সঙ্গে দু-তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে তারা ভালোবাসে না। সাধারণত সফল রাজনৈতিক নেতা, বড় দরের শিল্পপতি অথবা প্রশাসক ইত্যাদি মানুষরা প্রাণচঞ্চল টাইপের মস্তিষ্কের অধিকারী। আর গবেষক, চিন্তাবিদ জাতীয় মানুষেরা ফ্লেগম্যাটিক (phlegmatic) বা আত্মপ্রতিষ্ঠ টাইপ। স্কিজোফ্রেনিয়া সাধারণত আত্মপ্রতিষ্ঠ টাইপের লোকেদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাদের সব কিছু গভীর ভাবে চিন্তা করার বা তলিয়ে বোঝার চেষ্টায় যদি বারবার বাধা পড়ে অথবা তাদের সমস্যা যদি তাদের পক্ষে সমাধান অসাধ্য হয় তা হলে তাদের গতিময়তা আরও কমে যায়, তারা নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের মস্তিষ্কর কার্মিককেন্দ্র (motor centre) এবং সংবেদনকেন্দ্র (sensorium) দুই-ই ক্রমশ শ্লথ, অনড় হতে থাকে। প্রথমে বাইরের জগত থেকে, তার পর পরিবারস্থ মানুষের কাছ থেকে এবং শেষে নিজের সত্তা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। চিকিত্সকেরা তাকে প্রত্যাহরণ সিনড্রোম (withdrawal) বলে অভিহিত করেন।
কিছু পরে রোগীদের মস্তিষ্ককোষ সঠিক ভাবে উদ্দীপনা সঞ্চালন বা পরিবহণ করতে পারে না। একটি কোষের সঙ্গে অন্য কোষের সংবাদ আদানপ্রদান সম্পর্ক বিকল হতে থাকে। একটি কোষগুচ্ছ স্বাভাবিক অবস্থায় অন্য একটি কোষগুচ্ছের কাছে যে সংবাদ অথবা উদ্দীপনা সংকেত বহন করত, এই অস্বাভাবিক অবস্থায় সেটা সম্ভব হয় না। বাইরের জগতের এবং শরীরের আন্তরযন্ত্র থেকে যে সব উদ্দীপনা সংকেত মস্তিষ্কে পৌছে ব্যক্তিকে সচেতন করত, বাইরের জগতের এবং শরীরের আন্তরযন্ত্রে কী ঘটছে তার সঠিক সংবাদ দিত, তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই রোগীর মুখে অসংলগ্ন এবং শ্রোতার পক্ষে দুর্বোধ্য কথাবার্তা শোনা যায়। রোগী শুধু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তা-ই নয়, মনে হয় যেন সে অন্য একটি নিজস্ব জগত তৈরি করেছে। তার মস্তিষ্কের এই অবস্থাকে বস্তবাদী চিকিত্সকেরা আপাত স্ববিরোধী বলে বর্ণনা করেছেন (paradoxical phase)। তার কথাবার্তায় পরস্পরবিরোধী উক্তি এবং অনেক রকমের অসম্ভব ও অবাস্তব উক্তি শোনা যায়। সে ক্রমশ নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন আত্মপরিচয় দেওয়ার ক্ষমতাও চলে যায়। প্রসঙ্গত, একটি রোগীর কথা মনে পড়ছে — রোগগ্রস্ত হওয়ার আগে সে একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিত্সক ছিল। তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে সে প্রথম দিকে কোনও উত্তর দিত না। শুধু মুচকি হাসত অথবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। কিছু দিন পরে সে যে নার্সিংহোমে ছিল সেখানকার পরিচারকের নাম বলত এবং বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে ওই নার্সিংহোমের ঠিকানা বলত। প্রায় দু’ বছর ধরে ওই একই নার্সিংহোমের সে একটি পরিচালকের তত্ত্বাবধানে দিন কাটাচ্ছিল। তার মস্তিষ্কে কোষগুচ্ছের মধ্যে স্বাভাবিক সংযোগ ও সংবাদ আদানপ্রদান ঘটছিল না। দু’ বছর আগেকার প্রায় সব ঘটনাই তার স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। তার মস্তিষ্কর গতিময়তা যে খুবই কমে গেছে এবং সে যে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এটা বুঝতে কাররওই অসুবিধা হবে না।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/20/2020