অর্থনীতিতে ‘অপ্রথাগত ক্ষেত্র বা ‘ইনফর্মাল সেক্টর’ কথাটি খুব বেশি দিনের নয়। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতিবিদ কীথ হার্ট সর্বপ্রথম এই পরিভাষাটি ব্যবহার করেন, ১৯৭১ সালে আফ্রিকার একটি সেমিনারে একটি বক্তৃতায়। ঠিক তার পরের বছরে (১৯৭২) আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের অনুমোদনে এই শব্দটি বিশেষ তাত্পর্য লাভ করে। এখন দেখা যাক, ‘অপ্রথাগত ক্ষেত্র’ বা ‘অপ্রথাগত শ্রমিক’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। তার মোটামুটি ‘সংজ্ঞা’ই বা কী হতে পারে।
তবে, এই শব্দটির প্রায়-সমার্থক একটি শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেটি হল ‘অসংগঠিত ক্ষেত্র’। আপাত ভাবে প্রায় সমার্থক মনে হলেও শব্দ দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্তত একটি পার্থক্যের কথা এখানে তুলে ধরাই যায়। সেটি হল—রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সমস্ত সংস্থা এবং ১০ জনের বেশি কর্মীবিশিষ্ট যে কোনও অ-কৃষিভিত্তিক বে-সরকারি সংস্থাই সংগঠিত ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। তার বাইরে যে কোনও সংস্থাই অ-সংগঠিত ক্ষেত্র। তবে উভয় ক্ষেত্রেরই অন্তর্ভুক্ত থাকেত পারে প্রথাগত ও অপ্রথাগত দু’ধরনের সংস্থাই। ১৯৭২ সালের পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তাঁদের বিধি-নির্দেশিকা অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অপ্রথাগত ক্ষেত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন জাতীয় তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সমীক্ষার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ভারতের পটভূমিতে আজও কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রটির কোনও সর্বসম্মত সংজ্ঞা গড়ে ওঠেনি। তাই এই বিশেষ সংজ্ঞাকে ঘিরে অর্থনীতিবিদ বিশেষজ্ঞমহলে আজও রয়েছে ‘নানা মুনির নানা মত’। তবে এই সব সত্ত্বেও বিষয়টি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা গড়ে তুলতে অসুবিধা হয় না।
আমাদের দেশে প্রচলিত অনেক সংজ্ঞার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সর্বাধিক ব্যবহৃত সংজ্ঞাটি দিয়েছে ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্রের সংস্থাসমূহের জাতীয় কমিশন (এনসিইইউএস)। ‘অপ্রথাগত ক্ষেত্র’ এবং ‘অপ্রথাগত শ্রমিক’—দু’টি বিষয় নিয়ে রয়েছে দু’টি স্বতন্ত্র সংজ্ঞা। প্রথমটির সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, “দ্য ইনফর্মাল সেক্টর কনসিসটস অফ অল আনইনকর্পোরেটেড প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজেস ওনড বাই ইনডিভিডুআলস অর হাউসহোল্ডস এনগেজড ইন দ্য স্কেল অ্যান্ড প্রডাকশন অফ গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস অপারেটেড অন এ প্রপ্রাইটারি অর পার্টনারশিপ বেসিস অ্যান্ড উইদ লেস দ্যান টেন টোটাল ওয়ার্কার্স”। অর্থাৎ অপ্রথাগত ক্ষেত্রের মধ্যে থাকবে ব্যক্তি বা গৃহস্থ মালিকানাধীন সব ধরনের বিক্ষিপ্ত বে-সরকারি সংস্থা, যারা দশ-এর কম কর্মীসহ স্বত্ব অথবা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পণ্য ও পরিষেবা বিক্রয় ও উত্পাদনের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টির সংজ্ঞা এই রকম : “ইনফর্মাল ওয়ার্কার্স কনসিসট অফ দোজ ওয়ার্কিং ইন দ্য ইনফর্মাল সেক্টরস অর হাউসহোল্ডস এক্সক্লুডিঙ রেগুলার ওয়ার্কার্স উইদ সোশ্যাল সিকিউরিটি বেনেফিটস প্রোভাইডেড বাই দ্য ফর্মাল সেক্টর উইদাউট এনি এমপ্লয়মেন্ট বাই দ্য এমপ্লয়ারস”। এখানে, অপ্রথাগত শ্রমিক বা কর্মচারীর একটি পরিচিতি বা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, অপ্রথাগত ক্ষেত্রে বা নিজ গৃহে কাজ করে যে শ্রমিক বা কর্মচারী, তাকেই বলা হবে ‘অপ্রথাগত শ্রমিক’। এরা সরকার বা সংশ্লিষ্ট নিয়োগকর্তা-প্রদত্ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। এই ক্ষেত্রের কর্মীরা কখনও খুব ছোটখাটো সংস্থায় ‘বেতনভুক্ত’ হিসেবে নিযুক্ত থাকতে পারে, কখনও বা হতে পারে ‘স্ব-নিযুক্ত’ পেশাজীবী। এই শ্রেণির এক বড় অংশের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল —শ্রমের সম্পর্ক এখানে মূলত অনিয়মিত ধরনের অর্থাৎ ‘মালিক-শ্রমিক’ চুক্তির অস্তিত্বই এখানে থাকে না। বরং এই সব ক্ষেত্রে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে নিকট-আত্মীয়তা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা অন্য কোনও সামাজিক সম্পর্ক।
ভারতের পটভূমিতে এই অপ্রথাগত ক্ষেত্রের অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রেয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। ফুটপাথের হকারি, জুতো-পালিশ থেকে শুরু করে দর্জিগিরি, জঞ্জাল-পরিষ্কার, এমনকী ভিক্ষাবৃত্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অপ্রথাগত ক্ষেত্রের চৌহদ্দির মধ্যে; অন্য দিকে আবার এই একই ক্ষেত্রের মধ্যে থাকতে পারে সাবকন্ট্রাকটর, ফ্রি-লান্সার, গৃহশিক্ষক এবং এ জাতীয় আরও অসংখ্য পেশা ও জীবিকা। মোট কথা, ধ্রুপদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে, যে কোনও ধরনের উত্পাদন ব্যবস্থার কার্যকারিতার জন্য জমি-শ্রম-মূলধন ইত্যাদি উপকরণের সমন্বয় অত্যাবশ্যক। অপ্রথাগত ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্তের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এখানে মূলধন কখনও থাকে কখনও থাকে না। থাকলেও তা নামমাত্র, জমি বা শ্রম তথা দক্ষতা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
এ কারণে প্রথাগত ক্ষেত্রের (সরকারি ও বে-সরকারি) যেমন বিভিন্ন খুঁটিনাটি পরিসংখ্যান ও তথ্য পাওয়া যায়, অপ্রথাগত ক্ষেত্রে তা যায় না। বাস্তব কারণেই হয়তো বা তা পাওয়া সম্ভবও নয়; তাই, এ সব ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য সংগ্রহ করতে হয় কখনও অনুমানের ভিত্তিতে, কখনও বা বিক্ষিপ্ত নমুনা-সমীক্ষার (র্যানডম স্যামপ্লিং) মাধ্যমে।
বিগত কয়েকটি দশক যাবৎ অপ্রথাগত ক্ষেত্রের মোট আয়তন, তার কর্মসংস্থান বৈশিষ্ট্য ঠিক কী রকম—সে প্রসঙ্গে এ বার কিছুটা নজর দেওয়া যেতে পারে। এই সূত্রেই আমরা খুঁজে পাব, প্রথাগত তথা সংগঠিত ক্ষেত্রের সাপেক্ষে আলোচ্য ক্ষেত্রটির তুলনামুলক অবস্থান এবং সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাব ও গুরুত্বের মাত্রা। এই অনুসন্ধানের সহায়ক একটি পরিসংখ্যান সারণি। এখানে দেওয়া হল। সারণি-১ এর বিভিন্ন উপ-শিরোনামভুক্ত
সারণি-১ সংগঠিত ও অ-সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রথাগত এবং অপ্রথাগত কর্মসংস্থান (মিলিয়নে) |
|||||||||
|
১৯৯৯-২০০০ |
২০০৪-০৫ |
২০০৯-১০ |
||||||
|
অপ্রথাগত |
প্রথাগত |
মোট |
অপ্রথাগত |
প্রথাগত |
মোট |
অপ্রথাগত |
প্রথাগত |
মোট |
অ-সংগঠিত ক্ষেত্র |
৩৪১.৩ |
১.৪ |
৩৪২.৭ |
৩৯৩.৫ |
১.৪ |
৩৯৪.৯ |
৩৮৫.০৮ |
২.২৬ |
৩৮৭.৩৪ |
সংগঠিত ক্ষেত্র |
২০.৫ |
৩৩.৭ |
৫৪.২ |
২৯.১ |
৩৩.৪ |
৬২.৫ |
৮২.১৪ |
৩০.৭৪ |
৭২.৮৮ |
মোট |
৩৬১.৮ |
৩৫.১ |
৩৯৬.৯ |
৪২২.৬ |
৩৪.৮ |
৪৫৭.৪ |
৪২৭.২২ |
৩৩.০০ |
৪৬০.২২ |
সূত্র : ভারত সরকার, যোজনা কমিশন, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০১২-১৭ (দিল্লি, ২০১২) |
পরিসংখ্যানগুলি সামগ্রিক ভাবে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে অপ্রথাগত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান প্রবণতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
আলোচ্য সারণি বহির্ভূত আরও দু-একটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ্য করা যেতে পারে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তরের (এনএসএসও) পর্যবেক্ষণ অনুসারে, দেশের মোট কর্মীবাহিনীর ৮০ শতাংশের উপর অপ্রথাগত শ্রমিক-কর্মচারীদেরই অনুপাত, তার মধ্যে আবার, ‘নগরীয় ভারত’-এর তুলনায় ‘গ্রামীণ ভারত’-এ এই হার তুলনামূলক ভাবে বেশি। এই একই সূত্র থেকে আরও জানা গেছে—দেশের সমগ্র কর্মীবাহিনীর সব চেয়ে বড় অংশই হল স্ব-নিযুক্ত এবং এদের প্রায় পুরোটাই অপ্রথাগত ঘরানার অন্তর্ভুক্ত, পাশাপাশি নিয়মিত বা ‘বেতনভোগী’ পর্যায়ে কর্মরত মানুষদের ৪০ শতাংশেরই বেশি অপ্রথাগত কর্মচুক্তির আওতায় রয়েছে।
সারণি-২ ২০০০-২০০৫ পর্বে ভারতের প্রথাগত ও অপ্রথাগত ক্ষেত্রে কর্মরত পৃথক ভাবে পুরুষ ও নারীর মোট সংখ্যা (মিলিয়নে) |
|||||||
ক্ষেত্র |
লিঙ্গ |
অপ্রথাগত কর্মী |
প্রথাগত কর্মী |
মোট |
|||
|
|
১৯৯৯-০০ |
২০০৪-০৫ |
১৯৯৯-০০ |
২০০৪-০৫ |
১৯৯৯-০০ |
২০০৪-০৫ |
গ্রামীণ |
পুরুষ |
১৮৬.১৭ |
২০৯.০১ |
১০.৫৭ |
১০.০৩ |
১৯৬.৭৪ |
২১৯.০৪ |
নারী |
১০১.৭১ |
১২১.৬০ |
২.৩১ |
২.৪৩ |
১০৪.০২ |
১২৪.০৩ |
|
মোট |
২৮৭.৮৮ |
৩৩০.৬১ |
১২.৮৮ |
১২.৪৬ |
৩০০.৭৬ |
৩৪৩.০৭ |
|
শহরভিত্তিক |
পুরুষ |
৫৮.৩৩ |
৭১.৬০ |
১৮.৭২ |
১৮.৮০ |
৭৭.০৫ |
৯০.৪০ |
নারী |
১৫.৫৩ |
২০.৪০ |
৩.৪৩ |
৩.৬০ |
১৮.৯৬ |
২৪.০০ |
|
মোট |
৭৩.৮৬ |
৯২.০০ |
২২.১৫ |
২২.৪০ |
৯৬.০১ |
১১৪.৪০ |
|
সমগ্র |
পুরুষ |
২৪৪.৫০ |
২৮০.৬১ |
২৯.২৮ |
২৮.৮৩ |
২৭৩.৭৮ |
৩০৯.৪৪ |
নারী |
১১৭.২৪ |
১৪২.০০ |
৫.৭৪ |
৬.০৩ |
১২২.৯৮ |
১৪৮.০৩ |
|
মোট |
৩৬১.৭৪ |
৪২২.৬১ |
৩৫.০২ |
৩৪.৮৬ |
৩৯৬.৭৬ |
৪৫৭.৪৭ |
|
সূত্রঃ এনএসএসওঃ ৫৫তম ও ৬১ তম রাউন্ড |
সারণি-২ (ক) উপরোক্ত দুই ক্ষেত্রে লিঙ্গানুপাতিক কর্মী-বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার (শতাংশে) |
|||
ক্ষেত্র |
লিঙ্গ |
অপ্রথাগত ক্ষেত্র |
প্রথাগত ক্ষেত্র |
গ্রামীণ |
পুরুষ |
২.৩৪ |
-১.০৫ |
নারী |
৩.৬৪ |
০.৯৯ |
|
মোট |
২.৮১ |
-০.৬৭ |
|
শহর ভিত্তিক |
পুরুষ |
৪.১৮ |
০.০৯ |
নারী |
৫.৬০ |
০.৯৭ |
|
মোট |
৪.৪৯ |
০.২৩ |
|
সমগ্র |
পুরুষ |
২.৭৯ |
-০.৩১ |
নারী |
৩.৯১ |
০.৯৮ |
|
মোট |
৩.১৬ |
০.১০ |
|
সূত্রঃ এনএসএসও |
অর্থনীতিবিদ নীলকন্ঠ মিশ্র ও রবিশঙ্কর ২০১৩ সালে আলোচ্য বিষয়ের ওপর একটি সমীক্ষা করেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণে, ভারতের ‘অপ্রথাগত অর্থনীতি’র আওতায় রয়েছে মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশ এবং সমগ্র জিডিপির ৫০ শতাংশ। তাঁরা এই অভিমতও প্রকাশ করেছেন যে, অ-কৃষিক্ষেত্রের প্রায় ৮৪ শতাংশই অপ্রথাগত ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। সাব-সাহারান আফ্রিকা ছাড়া সারা বিশ্বে, অপ্রথাগত ক্ষেত্রে ভারতের মতো দুর্দশাগ্রস্ত আর কোনও দেশই নয়।
সারণি দু’টিতে প্রথমেই যা নজর কাড়বে, তা হল—আলোচ্য সময়ে (২০০০ থেকে ২০০৫) অপ্রথাগত ক্ষেত্রে পুরুষ-কর্মী ও নারী-কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে এবং তা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। অথচ প্রথাগত ক্ষেত্রে, পুরুষ-নারী তথা মোট অবস্থা—এই পাঁচ বছরে প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে, হয়তো কিছুটা কমেছে। দ্বিতীয়ত, অপ্রথাগত ক্ষেত্রে, বার্ষিক শতাংশ বৃদ্ধির হারে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হল, গ্রাম ও শহর উভয় পটভূমিতেই, পুরুষদের তুলনায় নারী কর্মীদের বৃদ্ধিহার অনেকটাই বেশি। কিন্তু, প্রথাগত ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এর ঠিক বিপরীত প্রবণতা—বৃদ্ধির হার কোনও ক্ষেত্রে নামমাত্র, তার চেয়ে যা বেশি উদ্বেগজনক—এই হার কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঋণাত্বক বা নেতিবাচক। তৃতীয়ত, দেশের সমকালীন জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ শ্রমিক বা কর্মীবাহিনীর সদস্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে এ-ও এক অতি বিরল ঘটনা।
ভারতের অপ্রথাগত ক্ষেত্রের আলোচনায় আরও একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্ক কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের এই যে বিশাল অপ্রথাগত কর্মীবাহিনী, ঠিক কোথায়, কী রকম সংখ্যায় কাজ করে? সাধারণ ভাবে এটা অবশ্য প্রায় সকলেরই জানা, অপ্রথাগত শ্রমিক বা কর্মী মানে এক কথায় ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’, আর কাঠবিড়ালির মতো তাদের শ্রমের কম-বেশি ভূমিকা রয়েছে ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’ উত্পাদনের কর্মোদ্যোগে। কিন্তু এ রকম ভাসাভাসা ধারণার পরিবর্তে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিক তথ্য-পরিসংখ্যান, যা প্রতিফলিত হয়েছে সারণি-৩-এ।
বিভিন্ন পেশা ও ক্ষেত্রের অপ্রথাগত কর্মীদের বিশদ হিসাব সারণি-৩ থেকে জানা যায় সমগ্র কর্মীবাহিনীর সর্বাধিক আনুপাতিক অংশ (৯৮.৮৯ শতাংশ) হল কৃষিতে কর্মরত অপ্রথাগত পুরুষ-নারী। আবার, দেশের মোট অপ্রথাগত কর্মীদের ৬১ শতাংশই কৃষির আওতায়, আর বাকি ১৪টি ক্ষেত্রে এদের অনুপাত ৩৯ শতাংশ। কৃষিতে যুক্ত এই পর্বতপ্রমাণ অপ্রথাগত বাহিনীর তুলনায় অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে তা নামমাত্রই। আবার, গৃহকর্ম ও আনুষঙ্গিক কাজকর্মেও অপ্রথাগত কর্মী অনুপাতটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক এবং সেই অনুপাত হল ৯৯.২৩ শতাংশ (২০০৪-০৫)।
সারণি-৩ |
|||||
ক্ষেত্র বা শিল্প উপক্ষেত্র |
অপ্রথাগত কর্মী/শ্রমিকের মোট সংখ্যা (মিলিয়নে) |
মোট কর্মীবাহিনীর সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট অপ্রথাগত কর্মীর অনুপাত (শতাংশে) |
বৃদ্ধির হার (শতাংশে) |
||
কৃষি |
১৯৯৯-০০ |
২০০৪-০৫ |
১৯৯৯-০০ |
২০০৪-০৫ |
|
২৩৪.৭৯ |
২৫৬.০৭ |
৯৮.৭৯ |
৯৮.৮৯ |
১.৭৫ |
|
খনি |
১.৫৬ |
১.৭৮ |
৭১.৭৫ |
৬৭.৩৯ |
২.৬৮ |
উত্পাদন-শিল্প |
৩৬.৮৫ |
৪৯.৩০ |
৮৩.৬৫ |
৮৮.৩৮ |
৫.৯৯ |
বিদ্যুৎ |
০.২১ |
০.২৪ |
১৮.৭৫ |
১৮.৭২ |
২.৭৪ |
পূর্ত/নির্মাণ শিল্প |
১৬.৯০ |
২৫.৩২ |
৯৬.৪০ |
৯৭.৩৩ |
৮.৪২ |
ব্যবসা-বাণিজ্য |
৩৫.৪১ |
৪২.৫৪ |
৯৬.৬৯ |
৯৮.১১ |
৩.৭৪ |
হোটেল-ব্যবসা |
৪.৩৫ |
৫.৮০ |
৯৪.৩০ |
৯৫.০২ |
৫.৮৯ |
পরিবহণ |
১১.৪৪ |
১৫.২৮ |
৭৮.৩০ |
৮২.৭০ |
৫.৯৫ |
আর্থিক কাজকর্ম |
০.৬৩ |
১.২১ |
২৭.৮০ |
৩৯.২৪ |
১৪.১৫ |
গৃহ-নির্মাণ শিল্প |
২.২৪ |
৩.৭৩ |
৮৩.৭৩ |
৮০.০৯ |
১০.৭৫ |
প্রশাসন |
১.৬০ |
১.১৯ |
১৫.২৭ |
১৩.৪৬ |
-৫.৭৫ |
শিক্ষা |
৩.২৪ |
৫.২৯ |
৩৮.২২ |
৪৬.২৮ |
১০.৩২ |
স্বাস্থ্য |
১.৫০ |
২.১৮ |
৫২.৫১ |
৫৮.৮০ |
৭.৭৯ |
সমষ্টি প্রকল্প |
৯.২৮ |
৭.৯৭ |
৯৫.১৫ |
৯৪.৯৯ |
-৩.০১ |
গৃহস্থ-কর্ম ও অন্যান্য |
১.৭৪ |
৪.৭২ |
৯৩.৮৬ |
৯২.২৩ |
২২.০৮ |
মোট |
৩৬১.৭৪ |
৪২২.৬১ |
৯১.১৭ |
৯২.৩৮ |
৩.১৬ |
সূত্রঃ এনএসএসও |
আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা, এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা কৃষির তুলনায় নিতান্ত কম হলেও, সেখানেও অপ্রথাগত আনুষঙ্গিকতারই দাপট সর্বাত্মক। যেমন, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মরত মোট মানুষের মধ্যে অপ্রথাগত কর্মী বৈশিষ্ট্যের অনুপাত ৯০ শতাংশেরও বেশি, সে রকম কয়েকটি ক্ষেত্র হল—ব্যবসা বাণিজ্য (৯৮.১১ শতাংশ), পূর্ত-নির্মাণ শিল্প (৯৭.৩৩ শতাংশ), হোটেল-ব্যবসা (৯৫.০২ শতাংশ) ইত্যাদি।
ভারতের জাতীয় অর্থনীতিতে অপ্রথাগত কর্মীবাহিনীর, চূড়ান্ত প্রভাব ঠিক কী রকম? সম্ভবত, এক কথায় এর উত্তর হয় না। কারণ বিষয়টি জটিল। আপাত ভাবে দেখলে মনে হবে, ক্ষেত্র যা-ই হোক না কেন, কর্মসংস্থান তো বাড়ছে—কাজেই অর্থনীতির নিরিখে এটা তো একটা ইতিবাচক প্রবণতা। এর উত্তরে বলতে হয়, যে কোনও ধরনের কর্মসংস্থানই ইতিবাচক লক্ষণ নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ‘কর্ম-নিযুক্তি’র নামে ভারতীয় কৃষিতে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের প্রয়োজন ব্যতিরেকেই গ্রামীণ মানুষদের যে মাত্রাতিরিক্ত চাপ (আজও যা ৫৫-৬০ শতাংশের কাছাকাছি), তাকে ‘স্বাভাবিক কর্মসংস্থান’ বলা যায় না, তার একটা বড় অংশই যে ‘ছদ্ম-বেকারত্ব’ (ডিসগাইসড আনএমপ্লয়মেন্ট), এ কথা প্রায় সকলেরই জানা। ভারতের জাতীয় অর্থনীতির পটভূমিতে অপ্রথাগত শ্রমিক-কর্মীবাহিনীর কর্মসংস্থানের বাড়বাড়ন্ত, সেটাও বহুলাংশেই পূর্বোক্ত কৃষির ছদ্ম-বেকারত্বের সঙ্গেই তুলনীয়।
আসলে, এই প্রবণতা হল দেশের দরিদ্র মানুষের ‘অস্তিত্ব-রক্ষার সংগ্রাম’ বা ‘ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে’ বাঁচার আপ্রাণ প্রয়াস। দারিদ্রের সঙ্গে অপ্রথাগত কর্মীবৃদ্ধির একটি সরাসরি সম্পর্ক বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক সমীক্ষায় লক্ষ করা গেছে। দেখা গেছে, পশ্চাত্পদ, সেই সব রাজ্যগুলিতেই অপ্রথাগত কর্মী শ্রমিকদের বেশি বেশি রমরমা। এ কারণেই, ভারতের দরিদ্র রাজ্যগুলিতে অপ্রথাগত কর্মীদের আনুপাতিক চাপ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের জাতীয় গড়ের (৯২.৩৮ শতাংশ) চেয়ে বেশি; যেমন বিহার (৯৬.৪৬ শতাংশ), উত্তরপ্রদেশ (৯৫.৫৩ শতাংশ), মধ্যপ্রদেশ (৯৪.৯৩ শতাংশ), ওড়িশা (৯৪.৫৩ শতাংশ)।
অন্য দিকে তুলনামূলক সচ্ছল রাজ্যগুলিতে এই অনুপাত জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক কম—দৃষ্টান্ত হিসেবে কেরালা (৮১.৬১ শতাংশ), হরিয়ানা (৯০.২০ শতাংশ), তামিলনাড়ু (৮৯.৮৯শতাংশ)। এ ছাড়াও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-সহ কয়েকটি রাজ্যে এই হার প্রশংসনীয় ভাবে আরও কম, মাত্র ৭৫.১৮ শতাংশ।
আর একটি কথা বিশেষ ভাবে মনে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তা হল—অপ্রথাগত শ্রমিক বা কর্মীরা যে শুধুমাত্র অপ্রথাগত ক্ষেত্রে কাজ করে, এমনটা নয়। ঠিক তেমনই প্রথাগত বা সংগঠিত ক্ষেত্র হলেই সেখানকার সমগ্র কর্মীবাহিনীই যে ‘প্রথাগত’ স্বীকৃতিবাহী হবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। সে কারণে, আজও ভারতের সামগ্রিক প্রথাগত ক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক কর্মীবাহিনীই (৪৫ শতাংশের কাছাকাছি) অপ্রথাগত শ্রমিক-কর্মচারী।
এই প্রবণতা, জাতীয় অর্থনীতির প্রেক্ষিতে যে কতখানি নেতিবাচক, সেই বিষয়টি ধরা রয়েছে এনসিইইউএস-এর প্রাক্তন উপদেষ্টা ও অর্থনীতি-সমীক্ষক অজয় কুমার নাইকের এই প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণে, “দ্য কনসেপ্ট অফ “ইনফর্মাল ওয়ার্কার ইজ বেসড অন দ্য পারসনাল ক্যারাকটেরিসটিক্স অফ দ্য ওয়ার্কার রাদার দ্যান দ্য এন্টারপ্রাইজ. ইনফর্মাল ওয়ার্কার্স কনসিসট অফ ৯২. ৩৮ পারসেন্ট অফ টোটাল ওয়ার্কার্স ইন ইন্ডিয়া… অ্যারাউন্ড হাফ অফ দ্য ফর্মাল সেক্টর ওয়ার্কার্স আর ইনফর্মাল ওয়ার্কার্স. দিস ইন্ডিকেটস দ্যাট ক্যাজুয়ালাইজেশন অর দ্য অ্যামাউন্ট অফ কনট্র্যাকচুয়াল লেবার ইনক্রিজেস ইন দ্য ফর্মাল সেক্টর হুইচ ইজ এ ম্যাটার অফ গ্রেট কনসারন ফর পলিসি মেকারস”।
অর্থাৎ, ‘শ্রমের অনিয়ম’ বা ‘চুক্তি-শ্রম’-এর পরিমাণ ও পরিধি ক্রমে বেড়ে চলেছে। ফলে ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশের মোট কর্মীবাহিনীর মাত্র ৭ শতাংশ হল প্রথাগত ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। তাই, সংখ্যার হিসেবেও এই ক্রমহ্রাসমানতা বর্তমান সময়েও অব্যাহত। ভারতের সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী সংখ্যা ১৯৯৯-২০০০ সালে ছিল ৩৩.৭ মিলিয়ন, ২০০৪-০৫ এবং ২০০৯-১০ সালে ক্রমশ কমতে কমতে সেই সংখ্যা যথাক্রেম ৩৩.৭ মিলিয়ন এবং ৩০.৭৪ মিলিয়ন হয়।
যে কোনও দেশের অর্থনীতিতেই কর্মসংস্থান এক ইতিবাচক প্রবণতা। কিন্তু যে কোনও ধরনের কর্মসংস্থানই যে ‘ইতিবাচক’ নয়, ভারতের ক্রমোস্ফীত অপ্রথাগত কর্মসংস্থান-প্রবণতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফলে, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কর্মসংস্থান-উত্কর্ষ তথা জীবন-উত্কর্ষেই যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, শুধু তা-ই নয়—জাতীয় অর্থনীতির ক্রমোন্নতির পথেও তা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই, দেশের স্বার্থে অপ্রথাগত শ্রমিক-কর্মীদের, যতদূর সম্ভব প্রথাগত তথা সংগঠিত ক্ষেত্রের মূল স্রোতের আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের চটজলদি সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কৃষি, শিল্প বা অন্যান্য ক্ষেত্র—‘শ্রম-নিবিড়তা’র দিন প্রায় শেষ। কিন্তু, এ-ও সত্য, এই সময়ে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন ক্ষেত্র ও উপক্ষেত্র বিকশিত ও প্রসারিত হয়ে চলেছে। অপ্রথাগত কর্মীদের ‘অবাঞ্ছিত বৃদ্ধি’কে এই সব ক্ষেত্রে যাতে সংগঠিত ও সদর্থক ভাবে যুক্ত করা যায় তার জন্য উদ্ভাবনামূলক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের ভাবনা-চিন্তা করার আশু প্রয়োজন রয়েছে দেশের সর্বস্তরেই।
সূত্র : যোজনা, অক্টোবর, ২০১৪।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/14/2020