সামাজিক উন্নয়নের সামনে এইচআইভি-এইডস মহামারি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খাড়া করেছে। এই মহামারি দারিদ্র এবং অসাম্যকে বাড়িয়ে দেয়। সমাজের সবচেয়ে ভঙ্গুর অংশ, যেমন বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা ও গরিব মানুষের উপর সবচেয়ে বেশি বোঝা চাপায়। যে সব সংগঠন এবং রাষ্ট্র আগেভাগে এই সমস্যায় সাড়া দেয় না তাদের সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রকে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কারণ উৎপাদনশীলতা কমে, দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিকের সংখ্যা কমে যায় এবং সরকারি পরিষেবার চাহিদা বাড়ার ফলে শ্রমিকদের চিকিৎসার ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের জন্য প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। এরই জন্য আফ্রিকার সাহারা-প্রান্তীয় দেশগুলি-সহ বিভিন্ন দেশের জাতীয় অর্থনীতির উপর বড় প্রভাব পড়েছে।
- ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন এইডস সংক্রান্ত জাতীয় কাউন্সিল এইচআইভি/এইডসের হাত থেকে শ্রমশক্তিকে বাঁচানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
- কাজের জায়গায় অসংখ্য মানুষ এক স্থানে জড়ো হন। তাই এখানেই এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও যত্নের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো কাঠামো তৈরি করা যায়। এখান থেকেই এইডস ভাইরাস প্রতিরোধ করার ব্যাপারে সাহায্য করা সম্ভব।
- এইডস ও এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে যে কলঙ্ক এবং বৈষম্য জড়িয়ে রয়েছে তাকে প্রতিরোধ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
- ভারত সরকার কাজ ও পেশার ব্যাপারে বৈষম্য ঘোচানো বিষয়ক আইএলও-র ১১১ নম্বর কনভেনশনে অনুমোদন দিয়েছে। ফলে এইডস আক্রান্তদের অবস্থা আলাদা ভাবে তুলে ধরে তাদের জন্য একটি নীতি তৈরি করা প্রয়োজন যাতে এইডস আক্রান্ত ও আক্রান্ত হয়েছেন এমন সন্দেহভাজন শ্রমিকরা বৈষম্যের সম্মুখীন না হন। নীতি রূপায়ণ করাটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, ভারতে এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত কোনও আইন নেই যদিও এ ধরনের আইন তৈরির একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে কাজের ক্ষেত্রে এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত বৈষম্য বিষয়ক কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ রায় রয়েছে আদালতের। যেগুলিকে নীতি সংক্রান্ত বিবৃতির পশ্চাৎপট হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
- কর্মক্ষেত্রে এইডস প্রতিরোধকে গোটা বিশ্বে কমখরচের কৌশল হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়।
- প্রয়াস চলছে বটে, তবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য আজও কোনও নীতিগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি যাতে বৈষম্য ঠেকানো যায়, সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় এবং এইচআইভির ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা যায়।
- ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা অল্প থাকায় এবং গোটা বিষয়টি না বুঝতে পারায় সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের বহু নিয়োগকারী ‘কাজের জায়গায় প্রতিরোধ’ ব্যবস্থা গড়ে তোলেননি। স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি (এসএসিএস), অর্থাৎ যারা রাজ্যস্তরে এইডস প্রতিরোধের মূল কাজ করে, ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকদের সংগঠনের মধ্যে (সরকারি বা বেসরকারি যা-ই হোক না কেন) এ ব্যাপারে খুব কম সমঝোতা গড়ে উঠেছে।
- আগামী ১০-১২ বছরে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি প্রতি বছর ১ কোটি ৪০ লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরি করবে। এই সব কাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঢুকবে তরুণরা। এইচআইভির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার তাদের মধ্যে প্রভাব ফেললে অর্থনৈতিক প্রগতির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হবে। কাজের জায়গায় প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতি তৈরি হলে, এইচআইভি প্রতিরোধ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া এবং যথাযথ পরিষেবা দেওয়া সুনিশ্চিত করা যাবে।
ফলে কাজের জায়গায় এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় নীতি ভারতীয় শ্রমজীবীদের এইডস সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে, যার প্রভাব পড়বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে।
নীতি সংক্রান্ত রূপরেখা
নীতি সংক্রান্ত রূপরেখার ভিত্তি হল এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত নিম্নলিখিত তথ্য ---
- ১) হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এইডস যে সব জানা পদ্ধতির মাধ্যমে দেহে সংক্রমিত হয় সেগুলি হল-
- আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন।
- সংক্রামিত রক্ত বা রক্তজাতীয় কিছুর সংবহনের মাধ্যমে দেহে এই ভাইরাসের প্রবেশ।
- আক্রান্তের ব্যবহৃত নিডল বা সিরিঞ্জ সুস্থ দেহে ব্যবহার করা এবং
- আক্রান্ত মায়েদের গর্ভাবস্থা, প্রসব বা স্তন্যপান করানোর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটা।
- ২) সাধারণ কাজের জায়গায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে এইডস হচ্ছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এক জনের সঙ্গে কথা বললে বা তাকে ছুঁলে বা অফিসের কাজের জিনিস তার সঙ্গে ভাগাভাগি করলে বা একই বাথরুম, বাসনপত্র ব্যবহার করলে এইডস সংক্রমণ ঘটবে এমন কোনও প্রমাণ নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় এমন কর্মীদের ক্ষেত্রে (যেমন স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে মাঝে রক্ত বা রক্তজাতীয় পদার্থের সংস্পর্শে আসতে হয়) গোটা বিশ্বে প্রচলিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করার যথোপযুক্ত পদ্ধতি রয়েছে যা মেনে চলতে হবে। সুতরাং দৈনন্দিন কাজের জায়গা থেকে সংক্রমণ ছড়ায় না।
- ৩) এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন সংক্রমণ থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবান এবং সক্ষম থাকতে পারেন।
- ৪) এখন অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল চিকিৎসা পদ্ধতির লভ্যতার ফলে এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন এবং স্বাভাবিক কর্মজীবন কাটাতে পারেন।
লক্ষ্য ও এক্তিয়ার
লক্ষ্য
এই নীতির লক্ষ্য মানবাধিকারের মূল তত্ত্বের ভিত্তিতে এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত জাতীয় সংবেদন গড়ে তোলা যাতে কাজের জায়গায় এই মহামারীর প্রভাব কমানো এবং তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা যায়। বিশেষ করে এই নীতির লক্ষ্য—
- শ্রমিক ও তার পরিবারের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।
- যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা এবং চিকিৎসা, সাহায্য ও যত্ন পাওয়ার ব্যবস্থা করা।
- এইচআইভি/এইডসের সঙ্গে যে কলঙ্ক ও বৈষম্য জড়িয়ে আছে তা থেকে রক্ষা করে আক্রান্ত শ্রমিকদের কাজের জায়গায় সমান সুযোগ ও মর্যাদার ব্যবস্থা করা।
- এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত তথ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া বা স্থানান্তরে কাজের সন্ধানের ক্ষেত্রে সুরক্ষিত জীবনের ব্যবস্থা করা।
এক্তিয়ার
- এই নীতি সব নিয়োগকারী এবং শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য, এমনকী যারা কাজের জন্য আবেদন করেছেন তাঁদের জন্যও। সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্র, চুক্তিবদ্ধ শ্রম, স্থায়ী-অস্থায়ী পদ্ধতিতে নিযুক্ত, স্বনিযুক্ত, শ্রমিকের স্ত্রী/স্বামী/সন্তান ও তাঁদের নির্ভরশীল পরিবারের অন্য সদস্যরা এই নীতির আওতাধীন।
- নিয়োগকারী এবং শ্রমিকদের সংগঠন, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের সরকারি মন্ত্রক ও বিভাগ, সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি, ভারতে কর্মরত বহুজাতিক সংস্থাকে এই নিতি-রূপরেখা ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা তাদের নিজস্ব কাজের জায়গাগুলির জন্য নীতি তৈরি ও তা কার্যকর করতে পারেন।
নির্দেশাত্মক তত্ত্ব
এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত আইএলও-র কোড অফ প্র্যাকটিস এবং ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক’ মেনে এই নীতি তৈরি করা হয়েছে। এটি ভারত সরকারের জাতীয় এইচআইভি/এইডস নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মূল তত্ত্ব হল ---
এইচআইভি/এইডস, কাজের জায়গার বিষয়
এইচআইভি/এইডস কাজের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, এটি শ্রমিক ও সংস্থার উপর প্রভাববিস্তার করে যার ফলে শ্রমের দরুন খরচ বাড়ে, উৎপাদনশীলতা কমে। মহামারি ছড়ানো এবং তার প্রভাব ঠেকাতে কাজের জায়গা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বৈষম্যহীনতা
এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হয়েছে মনে করা হলে শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য করা বা তাকে কলঙ্কিত করা চলবে না। এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও কলঙ্ক দূর হলে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে অনেক দূর এগোনো যায়।
লিঙ্গ সাম্য
- অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, জৈবিক কারণে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে এই রোগ সংক্রমণের বা তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এইচআইভি/এইডস সংক্রমণ ঠেকাতে এবং নারীদের এইডসের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর উপযোগী করে তুলতে লিঙ্গ সম্পর্কের সাম্য ও নারীদের ক্ষমতায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাজের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ
কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ হওয়া দরকার এবং শারীরিক ও মানসিক ভাবে শ্রমিকদের সক্ষমতা বাড়ানোর উপযোগী হওয়া প্রয়োজন।
সামাজিক আদানপ্রদান
- এইচআইভি/এইডস নীতির সফল প্রণয়ন ও রূপায়ণের জন্য চাই নিয়োগকারী, শ্রমিক ও সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস।
নিয়োগের জন্য বাছাই নয়
- কর্মরত বা কাজের জন্য আবেদন করেছেন এমন কেউ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করার কোনও দরকার নেই। আবার কাজ থেকে বাদ দেওয়া বা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্যও এ ধরনের ঝাড়াইবাছাই অপ্রয়োজনীয়। কাজের জায়গায় এইচআইভির প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য নিয়োগকারীরা অবশ্য কোনও নাম না করে অসংশ্লিষ্ট সমীক্ষা করাতে পারেন। এই সমীক্ষা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার নৈতিক শর্ত মেনে, পেশাদারি শর্ত মেনে, এবং ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করে করা যেতে পারে। এ ধরনের গবেষণা চলার সময় শ্রমিকদের এ সম্পর্কে জানিয়ে দিতে হবে। যদি পরীক্ষার ফল থেকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে ব্যক্তির এইচআইভি স্ট্যাটাস জানার সম্ভাবনা থাকে তবে সমীক্ষা নামবিহীন হয়েছে এ কথা কখনওই বলা যায় না।
গোপনীয়তা
- কাজের জন্য দরখাস্তকারীকে বা কর্মরতের কাছে তার এইচআইভি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। সহকর্মীদেরও অন্য সহকর্মী সম্পর্কে এ ধরনের তথ্য দেওয়ার দরকার নেই।
- চিকিৎসা সংক্রান্ত গোপনীয়তার শর্ত মেনে মেডিক্যাল সিক্রেসি বিধি দ্বারা নিবদ্ধিত ব্যক্তিই ব্যক্তিগত তথ্য রাখতে পারেন।
আরও তথ্যের জন্য : National Policy on HIV/ AIDS