আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ভারত যে খুব একটা ভালো জায়গায় নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১২ সালে ১৫ বছরের বেশি মানুষদের মাত্র ৩৫ শতাংশের কোনও বিধিবদ্ধ আর্থিক সংগঠনে অ্যাকাউন্ট ছিল। সারা বিশ্বের বিকাশশীল দেশগুলিতে গড়ে ৪১ শতাংশ মানুষের অ্যাকাউন্ট আছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎপরতায় বর্তমানে ২২ কোটি ৯০ লক্ষ প্রাথমিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। বিধিবদ্ধ আর্থিক সংস্থাগুলি এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। কিন্তু এখনও বহু গ্রাম আছে যেখানে ব্যাঙ্কের একটিও শাখা নেই। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ঋণের মাত্র দশ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে যায়, যেখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বাস করেন। অতএব আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলার আর প্রয়োজন নেই।
২০১৪-এর ২৮ আগস্ট থেকে চালু হয় প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা (পিএমজেডিওয়াই)। এর লক্ষ্যমাত্রা হল আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে ৭.৫ কোটি পরিবারের জন্য ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া। যে দিন এই প্রকল্প চালু হয় সে দিনই দু’ কোটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এই প্রকল্পের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল প্রতিটি ভারতীয়র জন্য ব্যাঙ্কে একটি করে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া। প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি পরিবারের একটি করে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাক্ষরতাও তাদের দেওয়া হবে। ফলে কারও মধ্যস্থতা ছাড়া তারা সহজেই টাকা হাতে পাবে বা টাকা জমা দিতে পারবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, যাদের অ্যাকাউন্ট তাদের জন্য আর্থিক পরিষেবা দেওয়া হবে এবং সেই সঙ্গে তাদের ক্ষুদ্র বিমা ও পেনশন দেওয়া হবে। সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন ব্যাঙ্কের শাখা খোলা যে হেতু প্রায় অসম্ভব, তাই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের সুবিধার্থে ব্যাঙ্ক করেসপন্ডেন্ট নিয়োগ করা হবে। এদের সাহায্য ছাড়া এই প্রকল্প সম্পূর্ণ সাফল্যলাভ করতে পারবে না। দেশের আনাচে কানাচে ব্যাঙ্কের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে ভারত উন্নত দেশগুলির তুলনায় তো বটেই, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনাতেও অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য জন-ধন যোজনার প্রয়োজন ছিল। বাস্তবে, সবার জন্য আর্থিক সংগঠনের সমস্ত সুবিধা নাগালের মধ্যে এনে দেওয়া এবং ঋণদানের ব্যবস্থা করা দেশের আর্থিক উন্নয়ন এবং নতুন উদ্যোগ শুরু করার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষে সত্যিই সহায়ক।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং সবার জন্য আর্থিক সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করবার সুযোগ করে দেওয়া বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মূলধনের সঠিক, সুষ্ঠ ও সুষম বণ্টন এবং ঝুঁকির আশঙ্কা সর্ব শ্রেণির সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলেই এই আর্থিক বিকাশ ঘটতে পারে। এ ছাড়া আর্থিক অন্তর্ভুক্তি মানুষের ভাগে আয়ের অংশ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে এবং এর ফলে দারিদ্রের প্রকোপ কমতে থাকে। এ ছাড়া গরিব মানুষদের জন্য ঋণদানের ব্যবস্থা করে তাদের জন্যও একটু সুযোগ করে দেওয়ার ফলে সামাজিক অসাম্য কমায়। আর্থিক পরিষেবা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নাগালের ভিতরে এনে দেওয়ার ফলে স্বনিযুক্ত ক্ষুদ্র উদ্যোগ, গৃহস্থালিতে ভোগের মাত্রা বাড়া এবং আর্থিক কল্যাণ ইত্যাদির উন্নতি যে ঘটে, তা প্রমাণ করা আজ অত্যন্ত সহজ। বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলেন যে, দারিদ্র দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণ একটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার।
ভারতের মতো অপ্রথাগত অর্থনীতিতে গরিব মানুষ টাকা ধার করে আবার সুযোগ বুঝে দেনা মিটিয়ে তাঁদের রুজি রোজগার বা ব্যবসাপাতির প্রয়োজন কোনও মতে মেটান। আত্মীয় বন্ধু বা মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করা বা আবর্তনশীল সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে টাকা জমা রাখা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এবং এ ভাবে যতটুকু অর্থ পাওয়া যায় তা আদৌ এঁদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়। প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা একটি নির্ভরযোগ্য প্রকল্প যা দরিদ্রদের যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সঞ্চয় করতে উৎসাহিত করবে। দক্ষিণ এশিয়া ও ভারতে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙ্কের পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে পারলে তা অবশ্যই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে যা দেশ ও দশের উপকারে লাগবে।
ভারতের মতো দেশে আর্থিক সংস্কার আনাটাই সব সময়ে সব থেকে ভালো ফল দিয়েছে। যে সমস্ত আর্থিক সংগঠন নিরাপদ, ঝুঁকিবিহীন ভাবে আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে এবং মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে, সেগুলি এ দেশের পক্ষে সব থেকে সুবিধাজনক।
নির্ভরযোগ্য আর্থিক সংগঠনগুলি যদি উৎসাহব্যঞ্জক আর্থিক সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতি দেয় তা হলে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে উঠতে বাধ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলির গ্রামবাসী বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারীরা এ সুযোগ সব সময় পান না। এ ধরনের সুবিধা পেলে গরিব মানুষ প্রয়োজন মাফিক অর্থ ব্যয় করে সঞ্চয়ের জন্য সচেষ্ট হতে পারে। হাতের টাকা অনর্থক ভাবে খরচ করে ফেলার প্রবণতা তাঁদের কমে যায়।
প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা ওভারড্রাফট বা ঋণদানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঋণ পাওয়ার এই সুবিধা পেলে দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নতি ঘটবে, সিদ্ধান্তগ্রহণে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে এবং তারা ব্যবসা বা অন্যান্য রুজিরোজগারের পরিকল্পনাও করতে পারবে এই আর্থিক সহযোগিতার সুবিধা থাকার ফলে। এ ছাড়া গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য থাকবে ১ লক্ষ টাকার বিমার সুরক্ষা। বিমার এই সুরক্ষার ফল এরা কাজে কর্মে ঝুঁকি নেওয়ার এবং তেমন কোনও আর্থিক ক্ষতি হলে তা সামাল দিয়ে দ্বিতীয় বার শুরু করার মতো সাহস এবং আত্মপ্রত্যয় খুঁজে পাবে। এই আর্থিক সমর্থনটুকু না থাকার ফলে অনেক সময় দরিদ্র মানুষজনেরা ইচ্ছা ও দক্ষতা থাকলেও নতুন কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন না। যার ফলে তাঁরা দারিদ্ররেখাও অতিক্রম করতে পারেন না। গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙ্কের শাখা খোলার ফলে মানুষের আর্থিক অবস্থার একটু আধটু উন্নতি হতে দেখা যাচ্ছে। আর আর্থিক উন্নতি ছাড়াও, মানুষকে প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার আওতায় আনতে পারলে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আর্থিক সাহায্য, ভাতা ইত্যাদি তাঁরা সরাসরি পেয়ে যেতে পারেন। আর তার জন্য অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না। ব্যাঙ্কগুলি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা। কিন্তু ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট-এর আগে যাঁরা অ্যাকাউন্ট খুলবেন তাঁরা বেশ কিছু সুযোগ- সুবিধা পাবেন, যেমন একটি ‘রু-পে’ ডেবিট কার্ড, ১ লক্ষ টাকার দুর্ঘটনা বিমা, এবং ৩০ হাজার টাকা কভারেজের একটি জীবনবিমা। যাঁরা সময়মতো অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে থাকবেন তাঁদের ওভারড্রাফটের সুবিধা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার লক্ষ্য পূরণ করা বড় সহজ কাজ নয়। অ্যাকাউন্ট খুলতে সময় লাগে জনপ্রতি অন্তত কুড়ি মিনিট। যাঁরা কোনও দিন ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলেননি তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো আরও একটু সময় লাগতে পারে। গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট শাখাগুলিতে ব্যাঙ্ক কর্মচারী সংখ্যায় কম। দেরি হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। আট ঘণ্টায় অর্থাৎ একটা পুরো কাজের দিনে হয়তো সর্বসাকুল্যে ২৪টি অ্যাকাউন্ট খোলা যেতে পারে। বেশ কয়েক বছর আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রাথমিক অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশ দেয়। প্রায় দশ কোটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ঠিকই কিন্তু তাতে সময় লেগে যায় ৩ বছর।
প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার সূচনার দিনে সারা দেশের গ্রাম ও শহর মিলিয়ে ২ কোটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। অ্যাকাউন্ট খোলার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এই ভাবে বাড়তে থাকলে ব্যাঙ্কগুলির উপর প্রচুর চাপ পড়বে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক হিসাবে দেখা গিয়েছে, ভারতে প্রতি লক্ষ মানুষে ব্যাঙ্ক শাখার সংখ্যা কিছু বাড়লেও ব্রাজিল, রাশিয়া ও মেক্সিকোর তুলনায় তা কিছুই নয়।
ভারতে মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আওতায় এখনও পড়ে না। তারা এখনও মহাজন বা অপ্রথাগত ঋণদানকারী সংস্থার উপর নির্ভর করে। বর্তমানে দেশে ১,১৫,০৮২ টি ব্যাঙ্ক শাখা আছে যার মধ্যে ৪৩,৯৬২ বা ৩৮.২ শতাংশ ব্যাঙ্ক গ্রামাঞ্চলের। প্রতিটি ব্যাঙ্ককে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় শাখা ও এটিএম গ্রামাঞ্চলে খুলতে হবে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-এর নির্দেশ পাওয়ার পর এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া আরম্ভ হয়।
এটিএম নেটওয়ার্ককে আরও সফল করে তোলার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনায় ডেবিট কার্ডের ব্যবহার আরম্ভ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
দেশে এখন প্রতি এক লক্ষ মানুষের জন্য ১১টি করে এটিএম রয়েছে। রাশিয়াতে প্রতি এক লক্ষ জনের জন্য ১৮২টি, ব্রাজিলে ১১৮টি, মেক্সিকোতে ৪৭টি ও চিনে ৩৭টি এটিএম বর্তমান। তবে ভারতে গত বছরে এটিএমের সংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল বেশ ভালো, পৃথিবীতে দ্বিতীয়। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার যত প্রসার ঘটবে এটিএম ও ডেবিট কার্ড ব্যবহারকারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। এর ফলে চাপ বাড়বে ব্যাঙ্কগুলির উপর। তার প্রধান কারণ এটিএম সমস্ত অঞ্চলে সমান ভাবে ছড়ানো সম্ভব নয়।
বিমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৯ সালে বলবৎ হওয়ার পর থেকে ভারতে বিমা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ছিল মাত্র চারটি জাতীয় কোম্পানি। সে জায়গায় এখন ৫১টি বেসরকারি বিমা কোম্পানি হয়েছে। ২০১১-১২ সালে বিমা শিল্পের ইকুইটি ক্যাপিটাল ছিল মোট ৩২,৩২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জীবনবিমার অংশ ছিল ৭৭ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য বিমার অংশ বাকি ৩৩ শতাংশ। জীবনবিমার তুলনায় দ্বিতীয় ক্ষেত্রটির বৃদ্ধি দ্রুত ঘটেছে। ২০১১-১২ সালে জীবনবিমার প্রিমিয়ামের হার ৮.৫ শতাংশ কমে যায়। (সারা বিশ্বে ওই সময় কমে ছিল ২.৭ শতাংশ)। অন্যান্য বিমার বৃদ্ধি ঘটে ১৩.৫ শতাংশ (অন্যান্য দেশে এই বৃদ্ধির হার ছিল ১.৮ শতাংশ)। ২০১১ সালে বিমা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা, বিমা প্রকল্পের প্রসার এবং বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে নানা জিনিসকে বিমার নিরাপত্তা দেওয়া এবং তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ‘প্যান ইন্ডিয়া ইন্সিওরেন্স অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেন’-এর সূচনা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা যদি ভালো ভাবে কার্যকর করা হয় তা হলে বিমা কোম্পানিগুলির প্রসার শহর থেকে শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলে হওয়া দরকার কারণ গরিব মানুষেরা বিমার দ্বারা ভীষণ উপকৃত হবেন। এর জন্য চাই বিমা পণ্যের অভিনবত্ব, ভালো নেটওয়ার্ক, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের পরিমাণে বৃদ্ধি।
গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিমা কোম্পানিগুলির প্রয়োজন হবে ৬১,২০০ কোটি টাকা যা ভারতীয় বিনিয়োগ বাজারের পক্ষে তোলা কঠিন। বেসরকারি ও বিদেশি বিমা কোম্পানিগুলির অংশগ্রহণের ফলে (২৬ শতাংশ পর্যন্ত ঊর্ধ্বসীমা) বিমা ক্ষেত্রের অনেকটাই উন্নতি ঘটেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও‘ইন্সিওরেন্স পেনিট্রেশন’-এর (অর্থাৎ বছরে জিডিপি ও প্রিমিয়ামের অনুপাত) পরিমাণ জীবন বিমা ও অন্যান্য বিমা মিলিয়ে মাত্র ৪.১ শতাংশে রয়েছে। অন্যান্য বিমার ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারতের অবস্থান ৫২তম। ২০১১-১২ সালে পেনিট্রেশন ছিল ০.৭ শতাংশ (বিশ্বের বিনিয়োগের ২.৮ শতাংশ) জীবন বিমার ক্ষেত্রে দেশে পেনিট্রেশনের হার ছিল ৩.৪ শতাংশ (বিশ্বের নিরিখে ভারত ২.৮ শতাংশ, ইউকে ১২.৫ শতাংশ, জাপান ১০.৫ শতাংশ, কোরিয়া ১০.৩ শতাংশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯.২ শতাংশ)। আমাদের দেশে বিমাক্ষেত্র যে অনুন্নত, তার আরও একটি সূচক হল বিমা-ঘনত্ব (জন প্রতি প্রিমিয়ামের হিসাব)। ভারতে জীবনবিমা ও অন্যান্য বিমার ক্ষেত্রে যা যথাক্রমে ৪৯ ও ১০ মার্কিন ডলার, চিনে তা ৯৯ ও ৬৪ মার্কিন ডলার। এমতাবস্থায় দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণিভুক্তদের জন্য (যাঁরা প্রাথমিক ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন) বিমার ব্যবস্থা করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে এক বিরাট পদক্ষেপ। তবে এ ব্যাপারে কতটা সাফল্য আসবে বা না আসবে তা নির্ভর করে এর উপযুক্ত রূপায়ণ ও ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামো ও পরিষেবার উন্নয়নের উপর।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক বিকাশের জন্য যে সব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, তার মধ্যে সমস্ত শ্রেণির নাগরিকদের ব্যাঙ্কিং-এর আওতায় আনার প্রক্রিয়া অন্যতম। এর জন্য ব্যাঙ্কিং পরিষেবার নতুনত্ব আনতে হয়েছে সব দেশেই। যেমন, ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কিং’ মডেলের সূত্রপাত। এ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ককর্মীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা ও টাকা জমা দেওয়া বা ঋণদান ইত্যাদির কাজ করে থাকেন। এর ফলে সব জায়গায় পৃথক শাখা খোলার ব্যয় ও ঝঞ্ঝাট থাকে না। যেমন ব্রাজিলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই এমন গরিব নাগরিকদের কাছে সরকারি অনুদান তুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্ক করেসপন্ডেন্ট বা বিসি নিয়োগ করা হয়। ২০০০ সালের মধ্যে ব্রাজিলে এক তৃতীয়াংশ পৌরসভায় ব্যাঙ্ক শাখা খোলা হয়। এ দিকে ৯৫ হাজার ব্যাঙ্ক করেসপন্ডেন্ট মাত্র তিন বছরে ১২০ লক্ষ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেয় দেশের সমস্ত পৌর অঞ্চল জুড়ে।
ব্রাজিল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রায়শই টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা একটি লক্ষ্যে অবিচল ছিল। তা হল কত বেশি সম্ভব মানুষকে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ব্রেজিলের প্রত্যন্ত গ্রামে আজ একাধিক এটিএম রয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যঙ্কিং ব্যবস্থা সেখানে একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়। এই অভিজ্ঞতা ভারতের পক্ষে খুবই কার্যকরী। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে ভারত ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। ভারত অন্তর্ভুক্তিকরণের ব্যাপারে লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আছে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলিকে নিয়ে সম্প্রতি সরকার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাতে খুব শীঘ্রই অন্তর্ভুক্তিকরণের ব্যাপারে আমরা প্রথম বিশ্বের সমকক্ষ হয়ে উঠব। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষিত জনধন যোজনা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ব্যাঙ্ক করেসপন্ডেন্টদের কাজের সাফল্যে ব্রাজিলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। যার থেকে অন্যরাও অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। ব্রাজিলের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে পেরু, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, চিলির মতো দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে, যেখানে ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত পরিকাঠামো অত্যন্ত অপ্রতুল, সেখানে উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই ভালো ফল দিয়েছে। কেনিয়ার কথাই বলি। সেখানে সাফারিকম নামে সেলফোন নেটওয়ার্ক অপারেটর ‘এম পেসা’ নামে মানি ট্রান্সফারের সুবিধা দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ নথিভুক্ত গ্রাহক এর দ্বারা উপকৃত। এই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর আর্থিক পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না এমন মানুষের হার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ৬ শতাংশ হারে কমেছে।
আজ বৈদ্যুতিন টোলিযোগাযোগের মাধ্যমে ৭৫ শতাংশেরও বেশি কেনিয়াবাসী আর্থিক পরিষেবার সুবিধা ভোগ করেন। এই একই পদ্ধতিতে মেক্সিকোতেও ভালো ফল পাওয়া গিয়েছে। তারাও এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। সেখানে কল্যাণমূলক আর্থিক অনুদানের জন্যও ব্যাঙ্ক ব্যবহার হয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের এই ব্যবস্থা প্রাপক ও প্রেরক উভয়ের পক্ষেই অনেক সুবিধাজনক ও সাশ্রয়কারী। ভারতের জন্যও এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে। এর ফলে অর্থ সাশ্রয় ও হবেই, দুর্নীতিও রোধ করা সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনার একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা নয়। তা হলে এই অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন কল্যাণমূলক সরকারি প্রকল্পের অর্থ পাঠানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা নিয়মিত টাকা তুলবেন, জমাও করবেন। মধ্যস্থতাকারীদের অসাধুতা মানুষকে বিব্রত করবে না। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে যেমন অ্যাকাউন্ট খোলার ফলে মানুষের সুবিধা হয়েছে, তেমনই এখানেও অবশ্যই হবে বলে আশা করা যায়। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ বিপরীত মতও পোষণ করেন।
ডাক বিভাগের সাহায্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ঘটানোও আমাদের দেশে সাফল্য লাভ করতে পারে। গ্রামাঞ্চলে অল্প সময়ে নতুন শাখা বা অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে তোলার থেকে ডাক পরিষেবার সাহায্য নেওয়া অনেক বাস্তবসম্মত ও ব্যয় সাশ্রয়কারী ব্যবস্থা হবে বলে মনে হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ব্যাঙ্ক শাখা গড়ে তোলার আগে দু’টি কাজ সারা খুব দরকার। এক, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটিকে যথাসম্ভব সহজ করা। আর দুই, সাধারণ মানুষকে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগসুবিধা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। অন্যান্য দেশে এই দু’টি বিষয়ের উপর অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হয়। মূলত ব্যাঙ্কে করেসপন্ডেন্টদের মাধ্যমে এই কাজ করানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্পে ব্যাঙ্কিংয়ে মোবাইল ফোনও ব্যবহৃত হবে। *99#- এই সার্ভিস কোডের সাহায্যে অ্যাকাউন্টে কত ব্যালান্স রয়েছে, তা দেখে নেওয়া সম্ভব হবে।
ব্যাঙ্কিং করেসপন্ডেন্টদের দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ করানো গেলেও টাকা তোলা ও সঠিক লোকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ তাদের দিয়ে করানোর ঝুঁকি আছে। তাদের বর্তমানে মাসে ১৫০০-২০০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এই বেতন একেবারেই অপর্যাপ্ত। সরকার তাদের ৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাও নিষ্ঠাবান এবং পরিশ্রমী কর্মী পাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ভালো ব্যাঙ্ক কর্মী নিয়োগ সরকারের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ।
গোড়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলি এই যোজনার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ দেখাবে না ধরে নিয়ে সরকার খুবই কড়া বার্তা পাঠিয়েছে। খেলাপি ঋণের আগাম চিন্তা যেন কোনওভাবেই সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় না হয়। সেই দিকে লক্ষ্য দেওয়ায় এই প্রকল্প সফল হবেই।
সূত্র : যোজনা, অক্টোবর ২০১৪
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/26/2020