জনসাধারণের যে অংশ আবহমান কাল ধরে শুধুমাত্র তাদের লিঙ্গগত পরিচয়, বয়স, তুলনামূলক শারীরিক অক্ষমতা ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে অত্যাচারিত, অবহেলিত ও উন্নয়নে ব্রাত্য থেকেছে, নারী উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ বিভাগ সেই অংশের মানুষের সুরক্ষা, সমতা এবং সামাজিক অন্তভুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে।সমাজের এই অংশের মানুষদের মধ্যে আছেন নারী, বরিষ্ঠ নাগরিকবৃন্দ এবং প্রতিবন্ধী, রুপান্তরকামী ব্যক্তি, গৃহহীন ও মাদক/মদে অত্যাসক্ত ব্যক্তিরা।
নারী-উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ বিভাগের দপ্তরগুলি হল: সমাজকল্যাণ অধিকার, পশ্চিমবঙ্গ সমাজকল্যাণ পর্ষদ, ভবঘুরে নিয়ামকের কার্যালয়, প্রতিবন্ধীদের জন্য মহাধক্ষের কার্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ নারী কমিশন, পশ্চিমবঙ্গ নারী উন্নয়ন সংস্থা এবং রুপান্তরকামী উন্নয়ন পর্ষদ।
নারীর অধিকারের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিভাগীয় কাজকর্মেরও বিবর্ধন ঘটেছে। জাতীয় ও রাজ্যস্তরে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট আইন, নীতি ও পরিকল্পসমূহের দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্ভর করে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি জনতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ কৈশোরপ্রাপ্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই বিভাগ তার সর্বশক্তি কেন্দ্রীভূত করেছে।২০১৩-এ কিশোরী মহিলাদের উদ্দেশ্যে রাজ্যের প্রধান সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্প - ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প'-এর পথচলা শুরু হয়। পরিকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, বাল্যবিবাহ রোধ করে ও মেয়েদের শিক্ষাগত, আর্থিক ও সামাজিক অন্তভুক্তির মাধ্যমে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী সামাজিকভাবে অরক্ষিত মহিলাদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো এবং এর দ্বারা নিরাপদ ও হিতকর উপায়ে কৈশোরের পক্ষে উপযুক্ত উন্নয়নমূলক কাজতারা যেন সম্পন্ন করতে পারে তা সুনিশ্চিত করা।
‘কন্যাশ্রী প্রকল্প' সুশাসনের একটি মডেলস্বরূপ এর সমকেন্দ্রাভিমুখী কর্মপন্থা, বহুস্তরীয় নজরদারি ব্যবস্থা, বিভাগীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার (wbkanyashree.gov.in)-এর ফলস্বরূপ নাগরিক-কেন্দ্রিক পরিষেবা, সুদক্ষ পরিষেবা প্রদান ও সার্বিকভাবে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগত্যা বেড়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকস্তরে প্রকল্পটি একটি শুভ প্রচেষ্ঠা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং বহুসম্মানজনক পুরস্কারও লাভ করেছে।
১৯৯৩ থেকে পশ্চিমবঙ্গ নারী উন্নয়ন সংস্থা নারী-কেন্দ্রিক পরিকল্পগুলি রূপায়িত করতে থাকলেও জাতীয় নারী ক্ষমতায়ন মিশন-এর অধীনে গঠিত রাজ্য মিশন সংস্থা অপেক্ষাকৃত নতুন অক কর্মধারার নাম। রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এই সংস্থার সভাপতি। রাজ্য সরকারের প্রধান ২১ টি বিভাগের মন্ত্রী এর সদস্য এবং নারী -উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ বিভাগের মন্ত্রী সংস্থার আক্ষায়ক-সদস্য। সংস্থাকে কারিগরি সহায়তা দেবার জন্য ২০১২-তে স্থাপিত হয়েছে রাজ্য নারী সম্পদ কেন্দ্র (SRCW), আন্ত ক্ষেত্র সমন্বয় সুদৃঢ় করা ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে নারী -উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করা এইকেন্দ্রের প্রাথমিক কাজ।
যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন ‘স্বাবলম্বন' সামাজিকভাবে প্রান্তিক মহিলা ও রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন, তবে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ এই বিভাগ ‘স্বাবলম্বন স্পেশাল' ও ‘মুক্তির আলো' নামে দুটি কর্মসূচির রূপরেখা প্রণয়ন ও তার রূপায়ণের দায়িত্বে কর্মরত। যাঁরা বাধ্য হয়ে দেহব্যবসা অবলম্বন করেছেন তাঁদের সহায়তা ও তাঁদের সন্তানসন্ততিদের বিকল্প জীবিকার্জনে সহায়তাদানের জন্য এই কর্মসূচি দুটি চালু করা হয়েছে।
এই রাজ্যের মহিলা -যারা জনসংখ্যার অনুপাতে একটি বৃহৎ অংশের ভাগীদার তাদের জন্য যখন এই বিভাগ কাজ করছে, তখন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধীকার রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা একইভাবে বিশেষ নজর রেখে চলেছে। ভবঘুরে অধিকার, গৃহহীন ও নি:স্ব মানুষদের জন্য বেঙ্গল ভ্যাগরেন্সী এ্যাস্ট অনুসারে বিভিন্ন জেলায় ১১টি ভবঘুরে হোম, কলকাতা, হাওড়া এবং আসানসোল পৌর অঞ্চলে শেল্টার ফর আরবান হোমলেস স্কীম - একটি রাজ্য পোষিও প্রকল্প, তার অধীনে ৪৫টি আশ্রয়স্থল পরিচালনা করে থাকে। আশ্রয়স্থল ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ছাড়াও এখানকার বাসিন্দাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা পুনরায় সমাজভূক্ত হতে পারেন। এন জিও দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন হোমের মাধ্যমে মাদকাসক্তদের সহয়তাপ্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
বার্ধক্য ভাতা, বিধবাভাতা ও প্রতিবন্দী ভাতার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রসারণ ঘটানো হয়েছে।বিভিন্ন ধরণের ভাতার সুবিধা ছাড়াও দুস্থ প্রবীণ নাগরিকরা বিভিন্ন সরকারি হোমে আশ্রয়লাভ করতে পারেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল মেইনটেনান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফ পেরেন্টস্ অ্যান্ড সিনিয়ার সিটিজেনস্ রুলস্, ২০০৮ অনুসারে একটি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে- সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হওয়া এবং পরিবার থেকে বিতাড়িত প্রবীণ নাগরিকদের মকদ্দমা শুনানির ব্যবস্থা করা হয়।
প্রতিবন্ধী কমিশনার পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবন্দী মানুষদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে কাজ করেন এবং তাঁদের অধিকার যাতে লঙ্খন করা বা অস্বীকার করা না হয় সেই বিষয়ে সতর্ক থাকেন। প্রতিবন্দী কমিশনারের কার্যালয় থেকে আরও বিভিন্ন প্রকল্প ও অনুদানের সূচনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিবন্দী মানুষদের পুনর্বাসন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সহায়তা, বৃত্তিপ্রদান এবং এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতনতাবৃদ্ধি ও প্রচার সম্ভবপর হয়।এই বিভাগের ‘‘লিটল স্টার'' প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিৎসা, পরিবহণ ও বাসস্থান সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা এবং অন্যান্য সহায়তা যেমন খর্বকায় মানুষের জন্য ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
জুলাই ২০১৫ সালে দ্য ওয়েষ্ট বেঙ্গল ট্রানসজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-এর গঠন একটি বৃহৎ পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য করা যায়। এর প্রধান লক্ষ্য হল চূড়ান্তভাবে প্রান্তিক ও সংবেদনশীল রূপান্তরকামী মানুষদের উন্নয়ন ঘটানো, যারা মানুষের উন্নতির সূচকে বিশেষও শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পিছনে পড়ে আছেন। বিভিন্ন বিভাগের সদস্যদের নিয়ে একটি রাজ্য সমন্বয়সাধনকারী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে এই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের শিক্ষা, সুরক্ষা, চিকিৎসার সুবিধা, পুর্নবাসন ও উন্নয়নের বিষয়গুলি ত্বরান্বিত হতে পারবে। বেতার মাধ্যমে ইতিমধ্যে জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা হয়েছে এবং সিভিক পুলিশ ফোর্সে রূপান্তরকামী মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য কলকাতা পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।
সূত্র: নারী উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ বিভাগ, পশ্চিমবাংলা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020