রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে গ্রামীণ পুনর্গঠনের কাজ বীরভূমের এই লালমাটির প্রান্তরে প্রথম শুরু করলেন। সেই থেকে শ্রীনিকেতনের পল্লি সম্প্রসারণ কেন্দ্র বিশ্বভারতীর সবচেয়ে পুরনো বিভাগগুলির মধ্যে একটি বলে গণ্য হয়। গ্রামীণ পুনর্গঠনের কাজের পিছনে মূল মতাদর্শ হল-‘‘গ্রামে জীবনকে সম্পূর্ণত মেলে ধরা এবং তাদের স্বনির্ভর, স্বমর্যাদাপূর্ণ করে তাদের দেশের চিরাচরিত সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে আধুনিক উৎস ব্যবহার করে গ্রামবাসীদের দৈহিক, বৌদ্ধিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো।’’
পল্লি সম্প্রসারণ কেন্দ্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে উন্নয়নের অভিমুখ নির্দিষ্ট করেছে-এগুলি হল, গবেষণা, সম্প্রসারণ এবং প্রশিক্ষণ।
বর্তমানে এই কেন্দ্রের কাজ ৫০টি গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলি বীরভূম জেলার ইলামবাজার ও বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। কেন্দ্র যে কাজগুলি করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার লক্ষ্যে ৪০টি উন্নয়ন সমিতি, ১০টি মহিলা সমিতি এবং একটি স্বাস্থ্য সমিতি গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রামে পল্লী সম্প্রসারণ কাজের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে এই সব সমিতির সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা হয়। নিম্নলিখিত বিষয়ে গ্রামোন্নয়ন সমিতিকে সশক্তকরণ করার লক্ষ্যে নিয়মিত ক্ষমতাবৃদ্ধির কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়।
গ্রামের সামাজিক সমস্যাগুলি বিশেষ করে মহিলাদের সমস্যাগুলির সমাধান করার জন্য কেন্দ্রের কম্যান্ড এলাকায় মহিলা সমিতি গঠনের উপযোগিতা। কর্মসূচির সফল রূপায়ণের জন্য ১০টি গ্রামে ১০টি মহিলা সমিতি তৈরি করা হয়েছে। মহিলাদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হয়। এই কাজে মহিলা সমিতি ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি সহায়তা প্রদান করে। বিভিন্ন গ্রামে মহিলা সমিতি বর্ষামঙ্গল, বৃক্ষরোপণ ও রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা নিজেদের গ্রামে খেলাধূলা ও প্রতিযোগিতারও ব্যবস্থা করে।
৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের সামাজিক কাজে ব্রতী করার জন্য তাদের জড়ো করে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা হয়। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হল-
সারা বছর ব্রতীদল যে সব কাজ করে-
প্রতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রতীদলগুলি শ্রীনিকেতনের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘ব্রতী ও যুব উৎসবে’ অংশগ্রহণ করে। গ্রামে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরের আয়োজনের ব্যাপারে ব্রতীদলগুলিকে যুক্ত করে নেওয়া হয়।
মহিলা ক্ষমতায়ন ও গোষ্ঠী ক্ষমতায়ন প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির একটি বিশেষ কর্মসূচি এই কেন্দ্র গ্রহণ করেছে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হল-
গ্রামীণ সম্প্রসারণ কর্মসূচির মধ্যে গ্রামীণ পাঠাগারের সৃষ্টি একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। এর মাধ্যমে গ্রামে সাক্ষরতা কর্মসূচির রূপায়ণ সম্ভব হয়। এ ছাড়া গ্রন্থাগারকে তথ্য ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের জন্যও গড়ে তোলা যায়। ৩৮টি গ্রামীণ গ্রন্থাগারের সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে এই কর্মসূচির রূপায়ণ হচ্ছে। এই কাজে সক্রিয় আর্থিক সহযোগিতা করছে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন, কলকাতা। গোড়া থেকেই গ্রন্থাগারিক এবং সহ গ্রন্থাগারিক স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন।
এই গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য হল-
বর্তমানে কেন্দ্রের আটটি গ্রামে আটটি ছোটদের গ্রন্থাগার রয়েছে।এই গ্রন্থাগারগুলিতে ছোটদের বই, আনন্দের সঙ্গে জ্ঞানলাভের উপযোগী উপকরণ, খেলাধূলার সামগ্রী প্রভৃতি রয়েছে।
গ্রামীণ গ্রন্থাগার পরিষেবার নতুন সংযোজন-
মূল উদ্দেশ্য হল গ্রামবাসীদের মনে,বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা। সারা বছরে এই বিভাগ গ্রামে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের (বোলপুর) সঙ্গে মিলিত ভাবে দু’টি স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবির করে। আশপাশের গ্রামগুলিতে নিখরচায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরেরও আয়োজন করা হয়।
রবীন্দ্র কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, শ্রীনিকেতন এবং কৃষি বিভাগের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতার মাধ্যমে এই বিভাগ গ্রামে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচি রূপায়িত করে। এই বিভাগের মূল কাজ হল সচেতনতা গড়ে তোলা ও তা বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাতে গ্রামে কৃষি সম্প্রসারণের কাজ ঠিকমতো করতে পারে সে ব্যাপারে সহযোগিতা করা।
উপকৃতদের উন্নতির জন্য গোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী স্বনির্ভরতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, সচেতনতা এবং সাগ্রহীকরণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা। গ্রামের যুবনেতৃত্ব, মহিলা সমিতির সদস্যা, গ্রামোন্নয়ন সমিতি, স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি এবং অন্যরা প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে।
প্রশিক্ষণ/সাগ্রহীকরণ/সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচি এক নজরেঃ-
গ্রামে খেলা ও ক্রীড়া পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য গ্রামোন্নয়ন সমিতিগুলি তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন খেলাধুলার সামগ্রী যেমন-ফুটবল,ভলিবল,নেট ইত্যাদি কেনার জন্য সামান্য অর্থ সাহায্য করে।
সাধারণভাবে চিরায়ত লোক সংস্কৃতির পুনরুত্থানের জন্য এবং গ্রামীণ এলাকার চিরায়ত সম্পদ কাজে লাগিয়ে সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন গ্রামোন্নয়ন সমিতিগুলি বিভিন্ন কার্যক্রমের আয়োজন করে।
বিভাগের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত লোক সংস্কৃতিমূলক বিনোদন কর্মসূচির তালিকা-
হস্তশিল্পকে তুলে ধরা এবং তাকে উৎসাহিত করা, চিরায়ত হস্তশিল্পের পুনরুত্থান ঘটানো এই কর্মসূচির কাজ। শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন হস্তশিল্প সমিতি একটি নিবন্ধীকৃত সমিতি। এর কাজ হল দুঃস্থ হস্তশিল্পীদের কাজ বিক্রির উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। গ্রামীণ সম্প্রসারণ সমিতি একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের হস্তশিল্পের নমুনা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন মেলায় তাঁরা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন (যেমন পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব, মাঘোৎসব, রথীন্দ্র মেলা প্রভৃতি) তার ব্যবস্থা করা। এখানে শিল্পীরা কেমন ভাবে কাজ করেন তা সাধারণ মানুষ দেখতে পান, পাশাপাশি বিক্রয়কেন্দ্রেরও ব্যবস্থা থাকে।
বিশ্বভারতীর গ্রামীণ সম্প্রসারণ কেন্দ্র বিভিন্ন বাইরের এজেন্সি ও অভ্যন্তরীণ বিভাগের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে এবং গ্রামে বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা প্রদানের চেষ্টা করছে।
সুত্রঃ পোর্টাল কন্টেন্ট টিম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/16/2020