দুঃস্থ, অভিভাবকহীন এবং সমাজে ন্যূনতম পরিষেবা থেকে বঞ্চিত শিশু ও বালকদের (৬ বৎসর থেকে ১৮ বৎসর) প্রতিপালনের মহতী ইচ্ছা নিয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রমটি স্থাপনা করেন ইংরাজি ১৯২৪ সনে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধকালীন পৈশাচিকতা, দেশ ভাগের মতন আচম্বিতে আসা বিড়ম্বনা, সাংসারিক অশান্তি, অসামাজিক সুযোগসন্ধানী মানুষের লালসা ইত্যাদির ফলশ্রুতি রূপে অসংখ্য শিশু, অগণিত বালক আশ্রয়হীন, গৃহহীন, অভিভাবকহীন হয়ে এই জনসমাজে অবহেলিত জীবনযাপনে বাধ্য হয়। সমাজেরই অংশ অথচ অবহেলিত এই শিশুদের দায়িত্বভার বহনের জন্য সর্ব্বোপরি এদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য দেশে, বিদেশে সর্বদাই কিছু সমাজসচেতন মানুষ আবার কখনও বা কোনও দায়িত্ববান প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রাকস্বাধীনতার যুগে চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ মহৎপ্রাণ দেশনায়কদের কাছে দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের দায়িত্বভার এবং এই সামাজিক দায়িত্বভার সমান বা কখনও বা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। ‘‘আমি কংগ্রেস ছাড়িতে পারি কিন্তু সেবাশ্রম ছাড়িতে পারিব না।’’ লিখেছেন সুভাষচন্দ্র বসু একটি পত্রে।
এই সচেতনতাই দক্ষিণ কলিকাতার সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ। সামাজিক সচেতনতার এই প্রয়োজন কখনওই ফুরিয়ে যায়নি, বরঞ্চ প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এটি ক্রমবর্ধমান – তাই অনাথাশ্রম তথা সেবাশ্রমগুলির দায়িত্ব বেড়েই চলেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর ১৩ লক্ষ শিশু মারা যায় শুধু অপুষ্টিতে। বিবিধ শিশুস্বাস্থ্য প্রকল্প, শিশুশিক্ষা প্রকল্পগুলিকে জোরদার করার চেষ্টা চলছে ক্রমাগত, সাফল্যের জন্য জনসমাজ অপেক্ষারত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও দু’টি মন্ত্রণালয় বা দফতরকে এ রূপ কাজের জন্য নির্দিষ্ট করেছে -- ১টি সমাজকল্যাণ দফতর অপরটি মাস এডুকেশন এক্সটেনশন দফতর। সমাজকল্যাণ দফতরের অধীনে বর্তমানে ১৯টি সরকারি ও এনজিও পরিচালিত প্রায় ৭০টি আশ্রম দুঃস্থ শিশু ও বালকদের আশ্রয়দান, শিক্ষাদান করে চলেছে। সমাজকল্যাণ দফতর অনুমোদিত আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩২৪০ জন এবং প্রতি আবাসিক পিছু দেয় অর্থসাহায্যের পরিমাণ মাসিক ১১০০ টাকা। মাস এডুকেশন এক্সটেনশন দফতর অনুমোদিত আবাসিক বালক-বালিকার সংখ্যা মোট ১৫০০ জন। মাসিক অনুদান ছাত্র-ছাত্রীর পিছু ১২৫০ টাকা। বর্তমানে জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট-এর পরিশোধন, পরিবন্ধন হচ্ছে যুগপরিবর্তন তথা সমাজবিবর্তনের প্রেক্ষাপটে। সেটির দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে এই দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম এগিয়ে চলেছে ৭০টি বালকদের আশ্রয় দিয়ে, তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশসাধনের কাজটি একনিষ্ঠ ভাবে পরিচালনা করছে। উল্লেখযোগ্য এই সেবাশ্রমের একটি নিজস্ব সংবিধান আছে। এটি তৈরি করেন শ্রী রমাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯২৮ সনে। মাস এডুকেশন এক্সটেনশন দফতরের অনুমোদনে এখানে ৭০ জন বালকের আবাস। সরকারি নীতি ও নিজস্ব সংবিধানের মধ্যে সাযুজ্য রক্ষা করেই এই সেবাশ্রমের দীর্ঘ ৯১ বছরের পথচলা অব্যাহত রয়েছে। সেবাশ্রমে অন্তর্ভুক্তির জন্য মাস এডুকেশন এক্সটেনশন বিভাগীয় নির্ধারিত ফর্মে দরখাস্ত জমা করতে হয়। বিভাগীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বালকদের সেবাশ্রমে প্রেরণ হলে সেবাশ্রম কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে থাকেন। এ ছাড়া কিছু সংখ্যক আশ্রম সন্নিকটস্থ দুঃস্থ বালককেও সেবাশ্রমে পঠনপাঠনের সুযোগ দিয়ে থাকে (আবাসিক ভাবে নয়)। বালকদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করা হয় সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে সরকার পরিচালিত শিক্ষালয়ের মাধ্যমে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম এখানে চালু আছে। পরবর্তী পর্যায়ে সেবাশ্রম সন্নিহিত উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে বালকদের পাঠানো হয়ে থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রম অধিকাংশ বালকগণই সাফল্যের সাথে সম্পূর্ণ করে থাকে।
সূত্র : দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম
আবাসিক বালকদের পঠনপাঠনে সাহায্য করার জন্য কিছুসংখ্যক শিক্ষকও নিযুক্ত আছেন যাঁরা বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের সময়ের বাইরেও বালকদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আনন্দের বিষয় আশ্রমের ছাত্র শ্রী মিলন হাজরা ২০১৩ সনে মিনি জয়েন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুরুলিয়া গভর্ণমেন্ট পলিটেকনিক কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে সে পাঠক্রমে সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শ্রী সফিউদ্দিন সেখ ও শ্রী সৌরভ শিকদার এই বৎসর প্যারামেডিক্যালে সুযোগ পেয়েছে। আশ্রম অর্থসাহায্য দ্বারা এদের ভবিষ্যত গঠনের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট।
বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের জন্য সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ আবাসিক ছাত্রদের এবং তারই সাথে কিছু দুঃস্থ ছেলেকে ইলেকট্রিক হাউস ওয়্যারিং-এর প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরই সাথে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে আবাসিক ছাত্রসহ বালক-বালিকাকে এবং এই প্রশিক্ষণের জন্য টাটা ই-জংশন সংস্থাটি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ভবিষ্যতে বালক-বালিকাদের জীবিকানির্বাহে উপযোগী করে তোলার পরিষেবা হিসেবে আশ্রম গণ্য করে। খেলাধূলা, আবৃত্তি-গান, হাতের কাজ, আঁকা ইত্যাদি সৃজনশীল বিষয়গুলির উপর লক্ষ রেখে উপরোক্ত বিষয়ে শিক্ষক নিযুক্ত আছেন আবাসিকদের জন্য।
দেশবরেণ্য মহাপুরুষদের আশীর্বাদধন্য এই সেবাশ্রমে ১৯৮৪ সনে ভারতের রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন।
১৯৯৯ সনে শিশুকল্যাণ ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য পুরস্কৃত হয় এই সেবাশ্রম। ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সেবাশ্রমের জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন উপলক্ষে উপস্থিত থাকেন।
প্রতি বছর আবাসিকদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করিয়ে আনা হয়। এটিকে আবাসিকদের সার্বিক বিকাশের সহায়ক বলেই মনে করা হয়।
ইংরাজি কথপোকথন, যুগের প্রয়োজনে ইংরাজিতে মুখোমুখি বসে কথা বলা ইত্যাদি রপ্ত করাতে MAD (Make A Difference) সংস্থা কাজ করছে সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষানীরিক্ষার জন্য চিকিৎসকগণ আসেন। বিশেষ প্রয়োজনে রামকৃষ্ণ মিশন সেবাপ্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকবৃন্দও সাহায্য করেন।
শিশুর হৃদয়কোরকে উক্ত ভবিষ্যতের বীজটিকে রক্ষা করা, তাতে জলসিঞ্চন করে পল্লবায়িত বৃক্ষে পরিণত করা আর তারই পুষ্পে, ফলে বিশ্বকে রূপে-রসে-গন্ধে ভরিয়ে তোলাই সেবাশ্রমের ব্রত। জনমানস আরও একটু সচেতন হোক। স্মরণ করি সেই পংক্তি, ‘‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’’
সূত্র : দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020