২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশের ৮ কোটি ৪৫ লক্ষ ১০ হাজার অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৮.১৪ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ে মানুষ। তারা দেশের ১৫ শতাংশ ভূখণ্ড জুড়ে থাকে। বিভিন্ন পারিপার্শিক সূচক ও তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কেন তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। প্রসূতিমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, মালিকানাধীন কৃষি জমির পরিমাণ, পানীয় জলের সুবিধা, বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা : সব দিক দিয়েই আদিবাসীরা সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৫২ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। শুধু তা-ই নয়, সবচেয়ে দুঃখজনক হল ৫৪ শতংশ আদিবাসী অর্থনৈতিক সম্পদ (যেমন পরিবহণ ব্যবস্থা বা যোগাযোগের সুবিধা) ব্যবহারের সুবিধা লাভ থেকে বঞ্চিত।
ভারতীয় সংবিধানে সে ভাবে তফশিলি উপজাতির সংজ্ঞা দেওয়া নেই। সংবিধানের ৩৬৬(২৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সে সব সম্প্রদায়ই তফশিলি উপজাতি যারা ৩৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তফশিলভুক্ত। বলে ঘোষণা করা হয়েছে তারাই তফশিলি উপজাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সংবিধানের ৩৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনসাধারণের প্রতি বিজ্ঞপ্তি জারি করে রাষ্ট্রপতি যে সব গোষ্ঠীকে উপজাতি বা উপজাতি সম্প্রদায় বলে ঘোষণা করেছেন তারাই তফশিলি উপজাতি। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশের আদিবাসী জনসংখ্যা হল ৬ কোটি ৭৭ লক্ষ ৬০ হাজার অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৮.০৮ শতাংশ। আদিবাসীরা দেশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ি ও জঙ্গল এলাকাতেই মূলত বসবাস করে।
এই গোষ্ঠীগুলির বিশেষত্ব হল
১৯৯১-এ জনগণনা অনুযায়ী, তফশিলি উপজাতিভুক্তদের ৪২.০২ শতাংশ কাজ করে। তার মধ্যে ৫৪.৫০ শতাংশ চাষি, ৩২.৬৯ শতাংশ খেত মজুর। সুতরাং এই সম্প্রদায়ের যারা কাজ করে তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ মানুষই প্রাথমিক ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত। তফশিলি উপজাতিদের মধ্যে সাক্ষতার হার ২৯.৬০ শতংশ, যেখানে দেশের মোট সাক্ষরতার হার ৫২ শতাংশ। তফশিলি উপজাতিভুক্ত মহিলাদের এক তৃতীয়াংশই নিরক্ষর। প্রথাগত শিক্ষায় পড়া-ছুটদের অত্যধিক হার এই বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। যে কারণে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এদের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ফলে তফশিলি উপজাতিভুক্তদের দারিদ্রসীমার নীচে থাকার হার জাতীয় হারের চেয়ে যথেষ্ট বেশি হবে এটাই স্বাভবিক। ১৯৯৩-৯৪ সালের জন্য যোজনা কমিশন যে হিসাব করেছিল, সেই হিসাব অনুযায়ী তফশিলি উপজাতিদের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৫১.৯২ শতাংশ এবং শহুরে জনসংখ্যার ৪১.৪ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে।
আদিবাসীদের শোষণ এবং সামাজিক বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং তাদের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক মান্নোনয়ন করতে ভারতীয় সংবিধান কতকগুলি বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। এ জন্য বিশেষ রণকৌশলেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গোড়াতেই নেওয়া এই বিশেষ রণকৌশলের নাম ট্রাইবাল সাব প্ল্যান (টিএসপি)। এই রণকৌশলের লক্ষ্য রাজ্য সরকারের নেওয়া আদিবাসী উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে অর্থ জোগানো, কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক , আর্থিক ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিভিন্ন প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া। এই কৌশলের মূল বনেদ হল বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে ট্রাইবাল সাব প্ল্যানের অর্থ বরাদ্দ সুনিশ্চিত করা। উপজাতিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ট্রাইবাল সাব প্ল্যান প্রণয়ন ও রূপায়ণ করার জন্য বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং কেন্দ্রের নানা মন্ত্রক ও দফতর যে সব উদ্যোগ নিচ্ছে, তা ছাড়াও তফশিলি উপজাতিদের স্বার্থে উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রক বেশ কয়েকটি প্রকল্প ও কর্মসূচি রূপায়ণ করছে।
সাক্ষরতার হারে অগ্রগতির ছবি
১৯৬১ |
১৯৭১ |
১৯৮১ |
১৯৯১ |
২০০১ |
|
---|---|---|---|---|---|
সাক্ষর জনসংখ্যা |
২৪% |
২৯.৪% |
৩৬.২% |
৫২.২% |
৬৪.৮৪ |
সাক্ষর উপজাতি |
৮.৫% |
১১.৩% |
১৬.৩% |
২৯.৬% |
৪৭.১০% |
মহিলা জনসংখ্যা |
১২.৯% |
১৮.৬% |
২৯.৮% |
৩৯.৩% |
৫৩.৬৭% |
সাক্ষর মহিলা উপজাতি |
৩.২% |
৪.৮% |
৮.০% |
১৮.২% |
৩৪.৭% |
‘তফশিলি উপজাতি’ শব্দবন্ধটি প্রথম দেখা যায় ভারতীয় সংবিধানে। সংবিধানের ৩৬৬(২৫) অনুচ্ছেদে এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে — ‘‘সেই আদিবাসী বা আদিবাসী গোষ্ঠী অথবা তার ভিতরের অংশ বা গ্রুপ, এই সংবিধানের প্রয়োজনে সংবিধানের ৩৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যাদের সূচিত করা হয়েছে’’।
তফশিলি উপজাতি সূচিত করা সম্পর্কিত ৩৪২ নম্বর অনুচ্ছেদ নীচে দেওয়া হল—
রাষ্ট্রপতি জনসাধারণের প্রতি বিজ্ঞপ্তি জারি করে (রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের সঙ্গে পরামর্শ করে) রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের যে সব আদিবাসী গোষ্ঠী অথবা গোষ্ঠীর অংশ বা গ্রুপকে নির্দিষ্ট করে দেবেন, তারা এই সংবিধানের স্বার্থে সেই রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সাপেক্ষে তফশিলি উপজাতি হিসাবে চিহ্নিত হবে।
সংসদ আইনের মাধ্যমে ধারা-১ (ক্লজ-ওয়ান) অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি জারি করে কোনও আদিবাসী গোষ্ঠী অথবা তার অংশ বা গ্রুপকে নতুন করে তালিকাভুক্ত করতে পারে বা তালিকা-বর্হিভূত করতে পারে। এই বিজ্ঞপ্তি কিন্তু পরবর্তী কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাতিল করা যায় না।
সুতরাং রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সাপেক্ষে তফশিলি উপজাতি ঘোষিত হওয়ার প্রথম বিশেষত্ব হল রাষ্ট্রপতিকে রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। এই আদেশ বদলানো যায় কেবলমাত্র সংসদে আইন প্রনয়ণ করে। সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তালিকা কেবলমাত্র রাজ্যভিত্তিক, সর্ব ভারতীয়ভিত্তিক নয়।
একটি আদিবাসী সম্প্রদায় তফশিলি উপজাতি হিসাবে চিহ্নিত হবে কি না, তা বিবেচনার সুচক হল অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মেশার ব্যাপারে দোলাচল, আদিম জীবনধারা নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা। এই মাপকাঠি সংবিধানে বলা নেই, কিন্তু এটাই প্রচলিত পদ্ধতি। ১৯৩১ সালের জনগণনা রিপোর্ট, ১৯৫৫ সালের ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস কমিশন রিপোর্ট, কালেলকর উপদেষ্টা কমিটির রিপোর্ট, ১৯৬৫ সালের এসসি/এসটি তালিকা সংশোধন সম্পর্কিত লকুর কমিটির রিপোর্ট এবং জয়েন্ট কমিটি অফ পার্লামেন্ট অন দ্য শিডিউলড কাস্টস অ্যান্ড শিডিউলড ট্রাইবস অর্ডার্স (অ্যামেন্ডমেন্ট)বিল ১৯৬৭-তে তফশিলি উপজাতির যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে তাতেই এই বিষয়গুলি উল্লিখিত।
সংবিধানের ৩৪২ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সাপেক্ষে তফশিলি উপজাতি সূচিত করে এ পর্যন্ত ৯টি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। এর মধ্যে আটটি বিজ্ঞপ্তি আদি রূপ অনুসারে বা সংশোধিত আকারে বলবৎ আছে। গোয়া পুনর্গঠনের ফলে ‘দ্য কনস্টিটিউশন (গোয়া, দমন অ্যান্ড দিউ) শিডিউলড ট্রাইবস অর্ডার ১৯৬৮’ নামক নির্দেশটি বাতিল হয়েছে। ১৯৮৭ সালের গোয়া, দমন ও দিউ পুনর্গঠন আইন অনুসারে গোয়ার তফশিলি উপজাতি তালিকা ‘দ্য কনস্টিটিউশন (শিডিউলড ট্রাইবস) অর্ডার, ১৯৫০-এর তফশিলের ১৯তম অংশে এবং দমন ও দিউয়ের তফশিলি উপজাতি তালিকা ‘দ্য কনস্টিটিউশন (শিডিউলড ট্রাইবস) (ইউনিয়ন টেরিটরিজ) অর্ডার, ১৯৫১-এর তফশিলের দ্বিতীয় অংশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশের নাম |
তারিখ প্রযোজ্য |
যে রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে |
---|---|---|
দ্য কনস্টিউশন (শিডিউলট্রাইবস)অর্ডার ১৯৫০(সি ও ২২) |
৬।৯।১৯৫০ |
অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, অসম,বিহার, গুজরাত, গোয়া, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল, মধ্যপ্রদেশ,মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম ওড়িশা, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরাএবং পশ্চিমবঙ্গ। |
দ্য কনস্টিটিউশন (শিডিউলডট্রাইবস)(ইউনিয়ন টেরিটরিজ) অর্ডার(সি ও ৩৩) |
২০।৯।১৯৫১ |
দমন-দিউ, লাক্ষাদ্বীপ |
দ্য কনস্টিউশন(আন্দামানঅ্যান্ড নিকোবর আইল্যান্ডস)শিডিউলড ট্রাইবস অর্ডার,১৯৫৯ (সি ও ৫৮) |
৩১।৩।১৯৫৯ |
আন্দামান ও নিকোবর |
দ্য কনস্টিটিউশন (দাদরা ও নগরহাভেলি)শিডিউলড ট্রাইবসঅর্ডার, ১৯৬২ (সি ও৬৫) |
৩০।৬।১৯৬২ |
দাদরা ও নগর হাভেলি |
দ্য কনস্টিউশন(উত্তরপ্রদেশ)শিডিউলড ট্রাইবস অর্ডার ১৯৬৭(সি ও ৭৮) |
২৪।৬।১৯৬৭ |
উত্তরপ্রদেশ |
দ্য কনস্টিউশন (নাগাল্যান্ড)শিডিউলডট্রাইবস অর্ডার ১৯৭০(সি ও ৮৮) |
২৩।৭।১৯৭০ |
নাগাল্যান্ড |
দ্য কনস্টিউশন (সিকিম)শিডিউলডট্রাইবসঅর্ডার ১৯৭৮(সি ও ১১১) |
২২।৬।১৯৭৮ |
সিকিম |
দ্য কনস্টিটিউশন(জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর)শিডিউলড ট্রাইবস অর্ডার ১৯৮৯(সি ও ১৪২) |
৭।১০।১৯৮৯ |
জম্মু ও কাশ্মীর |
* হরিয়ানা ও পঞ্জাব এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লি, পুদুচেরি ও চণ্ডীগড়ে কোনও সম্প্রদায়কে তফশিলি উপজাতিভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়নি।
তফশিলি উপজাতি শংসাপত্র সংক্রান্ত যে বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হবে—
১৯৯৯ সালে সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক থেকে আলাদা করে উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রক তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য হল সমন্বিত ও পরিকল্পিত উপায়ে ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত অংশ যারা সেই তফশিলি উপজাতিদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো। এই মন্ত্রক তৈরি হওয়ার আগে উপজাতি বিষয়গুলি বিভিন্ন মন্ত্রক দেখাশোনা করত। যেমন--
উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রকই তফশিলি উপজাতি কল্যাণের যাবতীয় নীতি, পরিকল্পনা ও তা রূপায়ণ করার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রক। ১৯৬১-এর ‘গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া (অ্যালোকেশন অফ বিজনেস) রুলস’-এর অধীনে যে সব বিষয় রয়েছে, সেই সব বিষয় অনুসরণ করেই উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রক আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণ করেছে। সেগুলি হল ---
সুত্রঃ Ministry of Tribal Affairs
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/15/2020
তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং মহিলা উদ্যোগীদের সহায়তা প...
পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিত্ত নিগম গড়ার উদ্দেশ...