১৮ বছরের আনোয়ারাকে দেখে প্রথমেই যে উপলব্ধি হয় তা হল, ওর চোখ দুটি আশ্চর্য রকম উজ্জ্বল। চোখের দিকে তাকালে অন্য রকম অনুভূতি হয়।
ধাগাগিয়া সোশাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অফিসঘরের বাইরে একটি টুলের উপর বসেছিল সে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ তার মুখ স্পর্শ করে যাচ্ছে। আনোয়ারা বলে চলেছে তার নিজস্ব দুনিয়ার কথা। ‘‘এই জায়গাটা কত সুন্দর বলুন!’’ তার চোখ চলে যায় এক পাশের সবুজ বনানীর দিকে। আর এক দিকে বিস্তৃত জলাশয়। সুন্দরবনের এই রহস্যময় আবিলতা তাকে ছুঁয়ে যায়। এই সুন্দরকে নিরাপত্তা দেওয়াই তার এখনকার কাজ।
১২ বছর বয়সে তার জীবনটা কিন্তু অন্য রকম ছিল। তখন সে নিজেই পাচার হয়ে চিরকালের জন্য অন্ধকারে তলিয়ে যেতে পারত। তার বাসস্থান ছোট আসকারা গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গে শিশু পাচারের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সে নিজেও এক বার এই নরকের আস্বাদ পেয়েছে। সেখান থেকে সে শুধু উঠে এসেছে তা-ই নয়, নিজের জীবনকে একেবারে নতুন করে গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
নারীশিশুকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তার লড়াই সর্বোচ্চ মর্যাদা পেয়েছ নোবেল পুরস্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের ফউন্ডেশনের কাছ থেকে। মালালা ফান্ড ৩০ দিন ধরে ‘গার্ল হিরো’ বা মহিলা বীরাঙ্গনাদের কীর্তি উদযাপন করছে (১১ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর)। এদের ‘দৃষ্টান্তমূলক সাহস ও নেতৃত্বদানকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
মালালা ফান্ড মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর লক্ষ্যে সহায়তা করে। শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে তাদের বক্তব্যকেও গোটা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে। আনোয়ারাকে সম্প্রতি এই সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি জানিয়ে বলা হয়েছে সে ‘শিশুপাচার, বাল্যবিবাহের সামাজিক ব্যাধি রোখার ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী।’ সেই কারণেই আনোয়ারা সত্যিকারের ‘গার্ল হিরো’।
শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়ার আগে কিন্তু আনোয়ারাকে নিজের জীবনের অন্ধকার, ভয়াবহ অধ্যায় পার করে আসতে হয়েছে। ১৯৯৬-এ তার জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে আনোয়ারা সবার ছোট। পাঁচ বছর বয়সে সে বাবাকে হারায়। মা স্থানীয় একটি স্কুলে রান্না করে অনেক কষ্টে পরিবার প্রতিপালন করতেন। ‘‘আমি স্কুলে যেতাম বটে, কিন্তু আর্থিক অবস্থার জন্য ষষ্ঠ শ্রেণিতে স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। তবে সে সব দিনের কথা মনে আনতে চাই না। এখন শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে যেতে চাই।’’ আশ্চর্য এক বিশ্বাস থেকে কথাগুলি উচ্চারণ করে আনোয়ারা। যখন তার ১২ বছর বয়স সেই সময় নিজেই পাচার হয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে। সেখানে পরিচারিকা হিসাবে অমানুষিক জীবন কাটাতে হচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে এক দিন সে পালিয়ে আসে। তার পর ধীরে ধীরে নিজেকে পাচার রোধে এক প্রধান প্রচারকের ভূমিকায় গড়ে তোলার পালা। সারা জীবন ধরে আনোয়ারা আর তার বাহিনী বাল্যবিবাহ, শিশু পাচার রোধে এলাকায় কী কী করেছে তা প্রায় মুখস্থের মতো আউড়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে সন্দেশখালির ৪০টি গ্রামের ৮০টি শিশু গোষ্ঠীর সে নেতৃত্বে রয়েছে। এই গোষ্ঠী বা বাহিনীগুলি আবার ‘সেভ চিলড্রেন ’ সংস্থা এবং ধাগাগিয়া সোশাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি পরিচালিত বিভিন্ন ‘বহুমুখী কাজের কেন্দ্র’গুলির সঙ্গে যুক্ত। এই সব কাজের সঙ্গে আনোয়ারা নিজেকে সংযুক্ত করেছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে। ‘‘আমি যখন যোগ দিয়েছিলাম সেই সময় মাত্র ১০টি গ্রুপ ছিল। বহু বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের এর সঙ্গে যুক্ত করতে শুরু করলাম। অনেকেই উৎসাহিত হল। এখন প্রায় ১৬০০ বাচ্চা গ্রুপগুলির সঙ্গে যুক্ত। আমি প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি।’’— বলে চলে সপ্রতিভ আনোয়ারা। হাতের মুঠোয় ধরা একটি মোবাইল সেট, যার মাধ্যমে প্রতিটি গ্রুপের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত সংযোগ হচ্ছে। ‘‘রাঁচিতে বছর তিনেক আগে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানেই পুরস্কার হিসাবে এই ফোনটি পাই। বেশ সুবিধা হয়েছে। বাচ্চারা যখন ইচ্ছা আমাকে পায় আবার আমি প্রয়োজনমতো সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।’’ আজকের আনোয়ারার মন্তব্য, ‘‘বাড়িতে টেলিভিশন নেই বলে খুব অসুবিধা। কিন্তু এই মোবাইলটা থাকায় ইচ্ছা মতো গান শুনতে পাই। নচিকেতা আর শ্রেয়া ঘোষাল আমার ফেভারিট।’’ মুখ তার উজ্জ্বল হাসিতে ভরে ওঠে।
সন্দেশখালি-১, সন্দেশখালি-২, মিনাখাঁয় বাল্যবিবাহ দিয়েছে বা অচেনা লোকের সঙ্গে কাজের জন্য বাচ্চাকে দূরে পাঠিয়েছে এমন পরিবারগুলির সঙ্গে কী ভাবে সে যোগাযোগ করে, বিস্তারিত নাম-ঠিকানা জোগাড় করে সে কথা বলছিল আনোয়ারা। আনোয়ারার বক্তব্য, ‘‘আমার দিদিদের ১৩-১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। তখন আমরা বাল্যবিবাহ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এটাই ছিল দস্তুর। আপনি যখন অসম্ভব যন্ত্রণা আর ঝঞ্ঝাটের মধ্য দিয়ে যাবেন, তখনই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রবণতা আপনার মধ্যে জন্ম নেবে। শত্রু বাড়বে। আর এই শত্রুতাই হবে আপনার কাজের চালিকাশক্তি। এখন মনে হয়, আমি যদি ঠিক সময়ে প্রত্যাঘাত না করতাম তা হলে সন্দেশখালি অঞ্চলের আরও অনেক নারীশিশু অন্ধকারে তলিয়ে যেত। এটা এখন আমার মিশন। নিজের দিকে ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জও বটে — যে করেই হোক ছোটদের যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। যদি এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াতাম তা হলে শিশু পাচার আর বাল্যবিবাহের নামে শোষণের ফাঁদে পড়ে অসংখ্য বাচ্চা শেষ হয়ে যেত।’’ চোখের জলকে মুখের হাসিতে পরিণত করা কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। যখন আনোয়ারা রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছিল তখন সে ছিল নিতান্তই কৈশোরের দোরগোড়ায়। আনোয়ারা সেই সব দিনগুলির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে চলে, ‘‘গ্রামের লোকেদের কাছে পৌঁছনোর আগে আমার পরিবারকে বোঝানোর ব্যাপার ছিল যাতে তারা বাড়ির বাইরে গিয়ে এ ধরনের কাজ করার অনুমতি দেয়। তাদের বলতাম, একবার ভেবে দেখ,আমি যখন দূরে চলে গিয়েছিলাম তোমরা কতটা যন্ত্রণা পেয়েছিলে। সুতরাং এই অবস্থায় অন্য পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানোটা কতটা জরুরি।’’ এর পরের ধাপে গোটা গ্রামকে বোঝানোটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। এক জন ‘অকালপক্ক’ মেয়ের ‘সদুপদেশ’ তারা শুনবে কেন? তারা প্রশ্ন করবে, ‘‘আরে তোমরা ছোটরা এ সবের কী বোঝ? আমাদের উপদেশ দেওয়ার তোমরা কে হে?’’ ‘‘বড়দের বোঝানোটা সত্যিই ঝক্কির কাজ। কিন্তু আমরা কখনও হাল ছাড়িনি। সব সময় তাদের সঙ্গে দেখা করতাম। যতক্ষণ না প্রকৃত অবস্থাটা তারা বুঝতে পারছে, হাল ছাড়তাম না। শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে ছাড়তাম আমরা কী বলতে চাইছি।’’ বলল আনোয়ারা।
আনোয়ারার সাহসের কথা জানাজানি হয়, যখন তাঁরই সমবয়সী একটি মেয়েকে সে উদ্ধার করে আর ওই দালালকেও হাতেনাতে পাকড়াও করে। সে দিন নিজেরই বয়সি কিশোরীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের এলাকায় সকলে রাত আটটায় শুয়ে পড়ে। বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। আমি কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসতাম। কিছু সঙ্গী নিয়ে দালালদের দেখতে পেলেই তাড়া করতাম। খাল বিল পেরিয়ে ঠিক তাদের ধরে ফেলতাম। ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আমাদের কাজ দেখে বড়দের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে গেল।’’ এই বার ধীরে ধীরে আনোয়ারা গ্রামের রোল মডেল হয়ে উঠতে শুরু করল। নাম ছড়াল আশেপাশেও। তার বাহিনী শুধু দালালদের হাতেনাতে ধরাতেই ক্ষান্ত হল না, তাদের চিহ্নিত করে, ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কাজেও পারদর্শী হল। কী ভাবে সেই কাজ হয়? আনোয়ারা বলে চলে —‘‘আমরা যে কোনও বহিরাগতকে গ্রামে দেখলেই অনুসরণ করি। সে খবর প্রতিটি বহুমুখী কর্মকেন্দ্রে ছড়িয়ে দিই। যদি দেখি তারা কোনও বাড়িতে ঢুকছে আমরা দু’-চারজন তখন নিতান্ত খেলার ছলে সেই বাড়ির আশপাশে ঘাঁটি গাড়ি। কী কথা হচ্ছে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করি। ফিরে এসে গ্রুপের ছেলেমেয়েদর সেই সব কথা জানাই।’’ যদি মনে করি, সে লোকের মতলব খারাপ, দালালি করতেই সে এসেছে, তা হলে যাকে টার্গেট করেছে আগে সেই বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব কথা খুলে বলি। বলি, কেন অপরিচিত লোকের সঙ্গে কোথাও যাওয়াটা ঠিক নয়। তার পর গ্রুপের পক্ষ থেকে সেই পরিবারের সঙ্গে দেখা করি। তাদেরও বোঝানোর চেষ্টা করি। তা সত্ত্বেও যদি দেখি বাচ্চাটিকে নিয়ে দালালরা পালানোর চেষ্টা করছে তা হলে তাদের খুঁজে ধরে এনে গ্রামের মধ্যে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি।’’ তাড়া খেয়ে কয়েক জন আড়কাঠি ইতিমধ্যে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কয়েক জন আবার শিশু পাচার রোধের কাজেও গ্রুপগুলির সঙ্গী হয়েছে। বাকিরা জীবনে কখনও আর আনোয়ারার এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করেনি।
আনোয়ারা আমাদের একটি বহুমুখী কর্মকেন্দ্রে নিয়ে গেল একটি গ্রুপের শিশুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য। ঘরে ঢোকা মাত্র চার দিক থেকে ‘দিদি, দিদি’ বলে এক গাদা বাচ্চা ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরল। ‘‘কী রে কেমন আছিস? খাওয়া দাওয়া করেছিস? কী রে তোর মুখে হাসি নেই কেন? কী হয়েছে?’’ ছোটদের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে লাগল আনোয়ারা। কিছু পরে নিজেরা চাইনিজ হুইসপার খেলা খেলতে শুরু করল।
কেয়া পরভিনের বয়স ১৫। সে আমাদের জানাল, ‘‘জানেন এক বার আমরা বিয়ে চলাকালীন একটি বাড়িতে ঢুকে একটা বাচ্চাকে উদ্ধার করেছি। দিদির কাছ থেকে আমরা কত কী যে শিখছি। আমি দিদির মতোই হতে চাই।’’ আনোয়ারার মতে, নারী পাচার রোধের শিশুকর্মী হওয়ার অনেক সুবিধা রয়েছে। ‘‘বাচ্চারাই প্রথমে এ ব্যাপারে খবর পায়। তারা সবার আগে তারই বয়সি কারও কথা শোনে। তাকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করে। বড়রা কেবল উপদেশ দিয়েই খালাস। এখন মৌলবীই বলুন বা ব্রাহ্মণই বলুন, গ্রামপ্রধান বা পুলিশ, সবাই আমাদের কথা শোনে। তবে আমাদের বিদ্রোহী ভাববেন না। আমরা বড়দের যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি।’’ অকপটে জানায় আনোয়ারা। ২০১২ সালে আন্তজার্তিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য আনোয়ারাকে মনোনীত করা হয়েছিল। পরের বছর সেই পুরস্কার পায় মালালা ইউসুফজাই। গত জুন মাসে আনোয়ারা ব্রাসেলসে গিয়েছিল গ্লোবাল পার্টনারশিপ অন এডুকেশন কনফারেন্সে ‘সেভ চিলড্রেন’-এর প্রতিনিধ হিসাবে। ‘‘আমার পাশপোর্ট হবে, বিদেশে যাব, ভাবতেই পারিনি। ওখানকার কাচের বাড়ি আমার খুব ভাল লেগেছ। অনেক চকোলেট খেয়েছি। ওখানে মালালার বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’’ ---আনোয়ারার কাছে মালালা এখন আদর্শ। ‘‘একদিন আমি ওর মতো হতে চাই। ও যে দিন নোবেল প্রাইজ পেল আমি এত খুশি হয়েছিলাম।ওর ব্যাপারে যেখানেই কিছু পড়ি সযত্নে তার ক্লিপিং রেখে দিই।’’ বলে আনোয়ারা।
মালালা তার কাছে আদর্শ হতে পারে কিন্তু একটা বাল্যবিবাহ রোধ করে বা পাচার আটকে সে যতটা আনন্দ পায় তার কাছে অন্য সব কিছু তুচ্ছ। সন্দেশখালি থেকে পাচার হয়ে যাওয়া কোনও বাচ্চা ফিরে এলে আনোয়ারা ছোটদের নিয়ে পার্টি দেয়। আনোয়ারার মন্তব্য, ‘‘আমরা সে দিন চাঁদা তুলে বহুমুখী কেন্দ্রে ডাল-ভাজা-ডিমের ঝোল দিয়ে ফিস্ট করি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নাচ-গান-নাটক করি। তার পর উদ্ধার করা শিশুটির সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলি। তার দুঃখের শরিক হই। তাকেও আমাদের গ্রুপের সদস্য করে নিই।’’ আনোয়ারার কাছে আনন্দ মানে নিরাপত্তা আর ভালবাসা। এক দিন সে নিজেই এ সবের জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। ‘‘আমি নিজে যা পাইনি, সেটাই অন্যদের দেওয়ার চেষ্টা করি।’’— আনোয়ারা স্পষ্ট স্বীকার করে।
একটি স্থানীয় কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করছে সে। গোটা গ্রামে মেয়েদের মধ্যে সেই প্রথম এত দূর লেখাপড়া করেছে। সকাল ছটায় ঘুম থেকে ওঠা, নামাজ পড়া, কলেজে রওনা হওয়ার আগে ২৫টি ছেলেমেয়েকে পড়ানো তার দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে পড়ে। ৪টের সময় কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে সে গ্রামে ঘুরে নিজের মেয়েদের খোঁজ নেয়। অন্য টিনএজ মেয়েদের মতো আনোয়ারা তার কানের দুল, চোখের কাজল ভালবাসে। গোলাপি রঙ তার ভীষণ প্রিয়। তবে পোষ্য জন্তু-জানোয়ার রাখার ব্যাপারে সে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। আনোয়ারার মন্তব্য, ‘‘কুকুর,বিড়াল আমিও ভালবাসি, কিন্তু তাদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। মানুষ বা জন্তু জানোয়ার যেই হোক না কেন, আমার কাছে খাঁচাবন্দি জীবন অসহ্য। এক দিন সবাই নিশ্চয় মুক্ত হবে।’’ আনোয়ারার সঙ্গী ডায়েরির পাতায় পাতায় কবিতা আর গান ভর্তি। সে সব রচনার বিষয়বস্তু মূলত নারী পাচার বিরোধিতা। নিজের জীবনের অসহ্য কাহিনীর কিছু কিছু স্মৃতিও নথিভুক্ত রয়েছে। আনোয়ারা জানায়, ‘‘মন খারাপ হলেই আমি লিখি।’’ ইংরেজি শেখা, সাইক্লিং করা আর কম্পিউটারে পারদর্শী হওয়ার আকাঙ্খা রয়েছে তার। বিস্তারিত কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। তার আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখই জানান দেয় কোন পথের শরিক হতে চায় সে।
(আনোয়ারা ডায়রির পাতা থেকে সংগৃহীত)।
(১৩ বছর বয়সের রচনা)
শিশু হলেও মানুষ আমরা
তোমরা কি তা বোঝ না?
শুধুই নিজেদের কথা ভাব
শিশুদের কথা ভাব না।
শিশুরও যে জীবন আছে
স্বপ্ন আছে,ব্যথ্যা আছে
কেউ তা মনে রাখ না।
(১৪ বছর বয়সের রচনা)
পাচারকারী বানাইলি মোদের ভিখারী
দিল্লিও গেলাম, মুম্বাইও গেলাম
ঝাড়খণ্ড গেলাম, রাজস্থান গেলাম
তবু আমার নাই কড়ি।
পাচারকারী বানাইলি মোদের ভিখারী
তোরে মারও দেব, জেলও খাটাব,
তবু তোরে আমরা ছাড়ব না,
পাচারকারী বানাইলি মোদের ভিখারী।
(১৫ বছর বয়সের রচনা)
মা, আমি বন্দি কাজের ঘরে
এই ছিল কপালে
চার দেওয়ালের মাঝখানে
নির্যাতিত হচ্ছি, মা
কাজের বাড়ি শুধু কাজ করা ছাড়া
একটু শান্তি দেয় না, মা।
সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ, ৩ নভেম্বর ২০১৪।
সময় যখন ‘কিছু ভাল লাগছে না’-র সংক্রমণ ছড়ায় এবং কোনও ওষুধেই নিরাময় নেই — সিনেমা, থিয়েটার, যাত্রাপালা, মেলা, সবই বিড়ম্বনা মনে হয় — তখন, সুজন, আপনি যেখানকার বাসিন্দা হোন, যা-ই হোক আপনার বৃত্তি, আপনি একটা পশ্চিমবাংলা ঘুরে আসুন, ঠিকানা বাতলে দিচ্ছি, সঙ্গে নিরাময়ের গ্যারান্টি।
বসতটির নাম চেঁচাই। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন থানায়, বালুরঘাট শহর থেকে অল্প রাস্তা, আপনার ব্যয়সামর্থ্য অনুযায়ী যানবাহন পেয়ে যাবেন। পাকা রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে, দু’পাশে ফসল, আপনি যেতে যেতে ধান না থাকতে পারে হয়তো সর্ষে থাকবে, অথবা ফাঁকা, কিন্তু পথের দু’ধারে অগুনতি গাছ থাকবে — গ্রামেরই এক ‘যুগলপ্রসাদ’, নিমাই তিগ্গা-র পোঁতা। বিভূতিবাবুর আরণ্যক-এর যুগলপ্রসাদ, ভুলে যাননি তো?
থেকে যান একটা বা দু’টো রাত, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরেই থাকার ব্যবস্থা, একটা মাটির ঘরে — লাগোয়া স্নান-শৌচের ব্যবস্থা। এটা ছিল পুরনো স্কুল বাড়ি, সর্বশিক্ষা মিশনের কল্যাণে পাকা বাড়ি এসে এটাকে অপ্রয়োজনীয় করে দেওয়ার আগেই বদলে ফেলা হল চমত্কার অতিথিশালায়।
পুরনো এ নিকেতন অতীতের মুগ্ধ সংরক্ষণ নয়, বরং নতুনের আবহের অঙ্গ। সে নতুনের আগমনে স্কুলের ছোট্ট মাঠের চার পাশে ফুল, পাতা, গাছ, স্কুলের ঠিক বাইরেটাতে গ্রামবাসীদের দেওয়া জায়গায় স্থানীয় আদিবাসী যুবক সংঘের সংযোগে একটা ছোট্ট সবুজ বাগান, স্কুলের মিড ডে মিলের জন্য। পাঁচিলের বাইরে সার দিয়ে গাছগাছালি, বেড়া নেই, গ্রামবাসীরাই রক্ষা করেন গরুছাগলের গ্রাস থেকে, গরুর মুখে ‘গোমাই’ লাগিয়ে রাখেন স্কুলের পাশ দিয়ে নেওয়ার সময়।
পাখির ডাকে যদি ঘুম না-ও ভাঙে, কিছুক্ষণের মধ্যে শিশুদের কলরবে আপনাকে উঠতেই হবে, ক্লাবের পক্ষ থেকে আয়োজন, সকাল-সন্ধ্যা বাচ্চাদের পড়াতে বসানোর। ছোট্ট গ্রাম চেঁচাই, মাত্র বাহান্ন পরিবার, পাশের পর্বতপুর পাড়ায় আরও বিশ ঘর, বেশির ভাগ আদিবাসী, কয়েক ঘর রাজবংশী ও বৈষ্ণব। এঁদের সঙ্গে দু’ দণ্ড কথা বলুন, জেনে নিন কোন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় তাঁদের এই ইস্কুলে, যেখানে পাঁচ–ছয় বছর আগেও দশ–বারোটা ছাত্রছাত্রী ছিল না, সেটা হয়ে উঠল এক আশ্চর্য বিদ্যায়তন, যেখানে বাহান্নটি শিশু বাস্তবিক মানব সক্ষমতা অর্জনের চর্চায় মগ্ন।
একটু পরেই হাজির হবেন পবিত্র মোহন্ত, যিনি শুধু চেঁচাই নন, গোটা এলাকায় শিক্ষা প্রসারে সমর্পিত, আসবেন সহকারী শিক্ষক সঞ্জীব মজুমদার। প্রত্যক্ষ করুন, কী ভাবে পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রভেদ মুছে গিয়ে চলতে থাকে শিক্ষার এক সর্বাত্মক অনুশীলন, পড়া লেখা অঙ্ক কষা ছড়াও ব্যায়াম, সংগীত, অঙ্কন। প্রতিটি শিশু পরিচ্ছন, বিদ্যালয়ের কোনও কোণে এক বিন্দু মালিন্য নেই, একটা কাগজের টুকরো পড়লেও ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে কোনও শিশু, দারিদ্রের অভিশাপ যাদের নিষ্পাপ চোখমুখ থেকে স্নিগ্ধতা কেড়ে নিতে পারেনি।
ঝকঝকে রান্নাঘরে মিড ডে মিল-এর পাচিকাদের মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস। ব্যবহৃত জল বৈজ্ঞানিক ভাবে পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে, শৌচালয়গুলো পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তৈরি শিশুরা নিজেরাই পরিষ্কার রাখে, শিক্ষকও হাত লাগান এই শিক্ষায়।
চতুর্দিকে শিশুদের নিজস্ব সৃষ্টি লেখা, আঁকা, হাতের কাজ। আর আছে তাদের খাতা–পেনসিল কেনার জন্য ‘আমার দোকান’। বিক্রেতা নেই, পাহারাদার নেই, শিশুরা দাম জানে, দরকার মতো জিনিস নিয়ে দামটা একটা বাক্সে ফেলে দয়, ‘পাই পয়সার হিসেব মিলে যায়’।
আসলে মিলটা অন্যত্র, শিক্ষকদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের মিল, যা শিশুদের সঙ্গে শিক্ষকের মিলটা এক এমন একটা উপলব্ধির ব্যাপার করে তুলেছে। এই মিল থেকে গ্রামবাসী যেমন এসেছেন স্কুলের কাছে, তেমনই স্কুল পৌঁছে গেছে তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে, নানা ভাবে। একটাই শুধু নিদর্শন দেখুন, গোটা গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয়েছে শৌচালয় এবং সেগুলো কেবল প্রকল্পের টার্গেট পূরণ করে না, ব্যবহৃত হয়। ‘স্বচ্ছ ভারত’–এর সরকারি ঘোষণার এবং মন্ত্রী–সান্ত্রিরা ঝাড়ু হাতে ছবি তোলার বহু আগেই স্কুলের প্রভাবে এ গ্রামে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত।
শুধু দৈহিক নয়, প্রসারিত মানসিক স্বচ্ছতায় গ্রামবাসীরা গড়ে তুলেছেন এমন এক সমাজ, যেখানে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে কয়েকটি বাড়ি মিলে যৌথ রান্নাঘর গড়ে তোলার। হয়তো বা ইউটোপিয়া, কল্পসমাজ, হয়তো বা সোভিয়েত অভিজ্ঞতা ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু মানুষই তো পারে কল্পনা করতে, কল্পনা আছে বলেই প্রাণ আছে — যে প্রাণ একটা গ্রাম, একটা স্কুল ছড়িয়ে, এখনও অলক্ষ্যে, বিস্তৃত হচ্ছে পশ্চিমবাংলার প্রান্তে, প্রান্তান্তরে।
প্রান্ত ধরে এগিয়ে যান মণিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, আরও এগিয়ে শূলপাণিপুর, দেখুন শিক্ষার স্থানিক আয়োজনে স্কুলগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ সংহতি কেন্দ্রে। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসুন হিলি — ঐতিহাসিক শ্রীগোহালি, একদা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিপুষ্ট যে লোকালয় রাজনৈতিক ইতিহাসের স্বেচ্ছাচারে শ্রীহীন, কিন্তু সেখানেও স্কুলে স্কুলে যৌবনের উন্মেষ। পর পর দেখতে পাবেন চকদাপট, ফেরুসা, নোয়াপাড়ায় কত বিরুদ্ধতা অতিক্রম করে একটা শিক্ষাসমাজ জেগে উঠছে।
আরও এগিয়ে আসুন কুশমণ্ডি ব্লকে। আপনাকে অবাক হতেই হবে, চোখকে প্রতারক মনে হবে হয়তো বা। কিন্তু যে নিশ্ছিদ্র ‘না’–রাজ্যের বাসিন্দা আমরা, যেখানে ভাঙাটাই রীতি, গড়াটা চিন্তাবাহুল্য, সেখানে চিন্তা ও কর্মের পারস্পরিকতায় পরিবর্তনের যে অদ্ভুত সংজ্ঞা তৈরি করেছেন এক দল মানুষ, সেটা অনুভব করাটাও সৌভাগ্যের।
আমাদের সুযোগ হল এ রকম তিন কুড়ি মানুষের কথা শোনার। বালুরঘাট শহরে, এক সান্ধ্য বৈঠকে, যা শেষ হতে হতে প্রায় মাঝরাত। শিক্ষকরাই এর কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আছেন অনেক সহমর্মী — যাঁরা অর্থ, শ্রম ও সময় দিয়ে নিজেদের এই সমাজীকরণের হকদার করে তুলেছেন, যাঁদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, প্রান্তিক চাষি, ক্ষেতমজুর, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বা কর্মচারী।
কী তাঁদের প্রেরণা? কেন তাঁরা ভবিষ্যতের একটা বৃহত্তর শুভ-র মায়াবী আকর্ষণে বর্তমানে ‘অযথা’ ক্লেশ বরণ করে নিচ্ছেন? এর একটা কোনও উত্তর নেই, কেননা লোক অনেক, মনোবৈচিত্রে যাঁরা বিশিষ্ট।
লবটুলিয়া বইহারের যুগল প্রসাদের ধারাবাহিক নিমাই তিগ্গা গাছ লাগিয়ে চলেন প্রকৃতির টানে, সেই টানে স্কুলের সঙ্গে তার সংযোগ।
শিক্ষিকা স্বাগতা মিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়েরর প্রেরণা তাঁর শিশুরা, যারা প্রত্যেকেই দেবতার আলাদা আলাদা রূপ’।
শিক্ষক বিদ্যুৎ দাস স্কুলের দেওয়াল জুড়ে নিখুঁত এঁকে যান ‘সহজ পাঠ’, এটা ‘আমার সামাজিক দায়িত্ব’ বলে।
মুক্তিনাথ হালদারের শৈল্পিক স্পর্শে কাদামাটি থেকে উঠে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ, খাতার পাতায় ফুটে ওঠে পাখি, ফুল, এমনকী বাঘের মুখাবয়ব — ‘শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শেখে নানা কিছু’, এটাই তাঁর প্রণোদনা।
বিচিত্র প্রতিভার শিক্ষকরা নিজেদের নিংড়ে দিতে চান, ‘নেশার টানে— শিক্ষকতার পেশাটা যতক্ষণ নেশা না হয়ে ওঠে, ততক্ষণ সেটা পেশাও হয় না’, জানান পবিত্র, মনোজ, মিলন, রতনের মতো শিক্ষকরা।
আবার, ব্যবসায়ী দুর্জয় কুণ্ডুর অকুণ্ঠ ত্যাগ স্বীকার কেবল বন্ধুত্বের টানে; তাঁর বন্ধুরা যে কর্মোদ্যোগের শরিক, সেখানে তিনিও এক অংশীদার। আপনিও, সুজন, এই প্রতিবদ্ধতায় শামিল হতে পারেন। কিছু যদি না-ও করতে পারেন, অন্তত আত্মীয়ের মতো নিকট থেকে এই অমৃতবর্ষা বোধায়ত্ত করতে পারেন।
শিক্ষাই তো অমৃত, যাকে আমরা দূরে ঠেলে বেছে নিয়েছি বিষপাত্র। রাজনেতা, সমাজমাণিক্যদের পশ্চাদানুসরণ করে যে অমৃতকে আমরা অবজ্ঞা করেছি, অবহেলা করেছি, সেই পার দূর করতে শুধু পশ্চিম দিনাজপুরের কোটরে নয়, বাংলার নানান প্রকোষ্ঠেই বোধহয় এক বিপ্রতীপ ধারার প্রবাহ; যে বাংলাকে মনে হয় ঘোর অনৈতিকতার পাঁকে নিমজ্জিত, পাপের কলস পরিপূর্ণ প্রায়, সেই বাংলাতেই আপাততুচ্ছ, জনারণ্যে স্বাতন্ত্রবিহীন এক দল মানুষের একটা অন্য সমাজ আমাদের আহ্বান করছে।
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরতি পথে একটু ঢুকে পড়ুন মালদার মানিকচক শিক্ষা নিকেতনে, কিংবা কোতোয়ালির কাছে গোপেশ্বর সাটিয়ার হাইস্কুলে। ‘কিচ্ছু ভাল লাগছে না’ নিরাময়ের অনেক কিছু পেতে পারেন।
একটু আভাস দিই; হাইস্কুলগুলোতে গেলেই শোনা যায় : বাচ্চারা প্রাইমারিতে কিছু শিখে আসে না, আমরা কী করব? অভিযোগটা সম্পূর্ণ নিরাধার তো নয়, বাস্তবিকই এমন অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যেখানে বর্ণপরিচয়টুকু না ঘটিয়েই শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার আখড়ায়। শুধু সরকারি স্কুল নয়, অধুনা একমেবাদ্বিতীয়ম বলে ‘মেনে নেওয়া’ প্রাইভেট স্কুলেও এমন দশা বিরল যে নয়, তা নরহাট্টাতেই দেখতে পাবেন। কিন্তু যেমনটা বললেন মানিকচক শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক জ্যোতিভূষণ পাঠক, ‘পাপ যে-ই করুক, ফলটা তো সমাজকেই ভোগ করতে হবে’। তা এই থেকে মুক্তির দায়টা সকলেরই।
সেই বোধে তাঁরা পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া যে-অংশটা ‘কিছু শিখে আসেনি’, তাদের আলাদা করে পোক্ত করে নিচ্ছেন, যাদের ভিতর থেকে কিছু দিনের মধ্যেই বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঔজ্জ্বল্য। একই উপলব্ধি নরহাট্টার প্রধান শিক্ষক রাজীবকুমার ঘোষালের।
রাষ্ট্রের কি ভূমিকা নেই? আছে, কিন্তু করুণ ভাবে যান্ত্রিক। সেখানে মন নেই, মানুষ নেই। আর সে কারণেই সমাজের ভূমিকা এত জরুরি। তার অঙ্কুরোদগম আপনি দেখতে পারেন। হৃদয় ও বুদ্ধির অপূর্ব সংমিশ্রণে অত্যুজ্জ্বল সব মানুষের সঙ্গেই আপনার দেখা হবে, যাঁরা ‘দিব্যজ্ঞানের চেয়ে কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভর করে’ নিজেদের কাজটা করে চলেছেন।
এক দিকে রাষ্ট্রীয় যান্ত্রিকতার বাধা, অন্য দিকে পরিচিতজনদের তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গবিদ্রুপ উপেক্ষা করে। এঁদের কর্মক্ষেত্র বাংলা। কিন্তু যাদের তাঁরা গড়ে উঠতে সাহায্য করছেন, তারা ইতিমধ্যেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে অন্য ভারতবর্ষের। চেঁচাইতে শিশুদের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে সমবেত উপলব্ধি : ‘ওয়ান লিটল, টু লিটল, থ্রি লিটল ইন্ডিয়া’। ‘টেন লিটল ইন্ডিয়াতে পৌঁছে তা আবার ফিরে আসছে ‘ওয়ান’–এ। স্কুলে একটা মাইক আছে। সারা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় লাউডস্পিকার, যেমনটা চিনা উপন্যাসে পড়ি। তবে সে দেশে লাউডস্পিকারের বাণী নিয়ন্ত্রণ করত পার্টির লোকাল কমিটি, এখানে সে কাজ করেন গ্রামের মানুষ নিজেরাই। শিশুদের অনেক ভারত থেকে এক ভারতের কল্পসংগীত ধ্বনিত হয় গোটা গ্রামে।
আপনি এবং আমরা, যারা লোকসমাজের তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিনিধি, তারা সকলেই এই অসামান্যের অনুশীলনে কিছু না কিছু যোগ করার সুযোগটা যেন না হারাই। পরশপাথর খুঁজে ফেরা খ্যাপাদের দলাটই তো পরশপাথর, তার পরশ পাওয়াটাই এক বিপুল আত্মসমৃদ্ধি।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ নভেম্বর, ২০১৪
পূর্ব কলকাতার জলা অঞ্চলের মৃন্ময়ী নস্কর কমপক্ষে এক ডজন মহিলাকে শিখেয়েছেন কী ভাবে ফেলে দেওয়া বাতিল কাগজ থেকে অফিস স্টেশনারি বা উপহারসামগ্রী বানানো যায়। উপকার করেছেন এক দিকে সমাজের, অন্য দিকে পরিবেশেরও। এ বার মৃন্ময়ী ১৮০০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গোটা বিশ্বকে দেখাতে যাবেন কী করে বাতিল জিনিস থেকে সম্পদ তৈরি করা যায়।
বিশ্ব মানচিত্রে রামসর সাইট বলে চিহ্নিত পূর্ব কলকাতার জলা অঞ্চলের গোলতলা ভেড়ির উল্টো দিকের বস্তিতে থাকেন ২৩ বছরের স্নাতক মৃন্ময়ী। এ বার তিনি লিমায় গিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স’-এ গোটা বিশ্বকে দেখাবেন কী ভাবে ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ অর্থাৎ বাতিল জঞ্জাল থেকে অর্থকরী দ্রব্য উৎপাদনে তিনি সফল হয়েছেন। ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ প্রকল্পে ১২টি দৃষ্টান্ত দেখানো হবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি টিম ‘পরিবর্তনের দিশারী’ শীর্ষক উদ্যোগের অঙ্গ হিসাবে খুঁজে খুঁজে গোটা বিশ্ব থেকে এই দৃষ্টান্তগুলি সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে মৃন্ময়ীর কাজও স্থান পেয়েছে।
কলকাতায় ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ প্রকল্প চার বছর আগে চালু হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট (সেফ) কলকাতার কঠিন বর্জ্যের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে করতে পরীক্ষা শুরু করে কী ভাবে বাতিল পদার্থ থেকে কার্যকর কিছু তৈরি করা যায়। এটি স্বাধীন গোষ্ঠীনির্ভর উদ্যোগ হিসাবে বস্তিবাসী মহিলাদের নিয়ে শুরু হয়েছিল। মৃন্ময়ীর বক্তব্য, ‘‘আমরা বর্জ্য পদার্থকে একেবারে উৎস থেকেই আলাদা করে নিই। জৈব বর্জ্যকে মাঠে ফেলে কম্পোস্ট তৈরি হয়। আর বর্জ্য কাগজ মহিলাদের পরিচালিত ওয়ার্কশপে রিসাইকেল হয়। এর থেকে তৈরি হয় হস্তশিল্পের নানা সামগ্রী।’’ তিনি ‘সেফ’ উদ্যোগের কর্মী অমৃতা চট্টোপাধ্যায় ও চিরঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পেরুর রাজধানী লিমায় গিয়ে ১২৮টি দেশের প্রতিনিধির সামনে তাঁদের প্রকল্পের কথা শোনাবেন। এই কনফারেন্স হবে ডিসেম্বরে পর্যন্ত। মৃন্ময়ী এই প্রকল্পের টিম লিডার হিসাবে উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করার বিষয়টি, উদ্যোগের আরও খুঁটিনাটি বিষয়, সিএসআর প্রোমোশন দেখভাল করেন। দুঃখের বিষয় ৪৫ বছর বয়সী মায়া ঘোষ যিনি বর্জ্য জলাভূমিতে মাছ চাষ করেন এবং এই উদ্যোগের প্রধান, তিনি পাসপোর্ট না থাকার কারণে লিমায় গিয়ে ‘লাইটহাউস অ্যাক্টিভিটিস’ পুরস্কার গ্রহণ করতে পারছেন না।
বর্তমানে ১৮টি কর্পোরেট সংস্থা এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার কেজি বর্জ্য তাদের সহযোগিতায় রিসাইকেল হয়ে কাজে লাগছে। শুধু কর্পোরেট সংস্থাই নয়, পুরসভাও এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। লিমা সফরের ফলে মৃন্ময়ীদের সামনে নতুন সুযোগ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখানে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, রকফেলার ফাউন্ডেশনের মতো সমমনস্ক সংস্থাগুলির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হবে। ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ প্রকল্পে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আবহাওয়া অভিযোজনের বিষয়ে তাঁরা প্রতিশ্রুত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবেন এমনটাই অনুমান।
‘‘কলকাতায় প্রতিদিন ৫ হাজার টনেরও বেশি কঠিন বর্জ্য নির্গত হয়। মাটিতে এই বর্জ্য ফেলায় মাটির নীচের জল দূষিত হওয়ার ও মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়ার বিপদ থেকে যায়। এই মিথেন গ্যাস আবহাওয়ার পরিমণ্ডলে তাপকে ধরে রাখার ব্যাপারে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি কাজ করে। আমরা দেখিয়েছি, ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ প্রকল্প এই সমস্যার সমাধানে উপযোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এই গোষ্ঠীভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনের ব্যবসায়ী মডেলের মাধ্যমে খোলা বর্জ্য জনিত দূষণ সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে।’’ –বললেন অমৃতা চট্টোপাধ্যায়। গোড়া থেকে ইনিই এই প্রকল্পের দেখভাল করার কাজ করছেন।
‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ সহ বাকি ১১টি লাইটহাউস অ্যাক্টিভিটিস সম্পর্কে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ক্রিশ্চিয়ানা ফিগুয়েরার মন্তব্য, ‘‘এই প্রকল্পগুলি গোষ্ঠী, শহর, ব্যবসা, সরকার -- সব পক্ষকেই নিম্ন-কার্বনজনিত ঐতিহ্যময় ভবিষ্যতের পথে যেতে সাহায্য করছে।’’
গ্লোবসিন ক্রিস্টালের ডিরেক্টর পবন চুরিয়াল ‘ট্র্যাশ টু ক্যাশ’ প্রকল্পের লিমা যাত্রা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই প্রকল্পের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত। কাগজ-কুড়োনেরা এর ফলে অনেক ভালো জীবনযাত্রার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু শুধু তার জন্যই নয়, এই উদ্যোগের ফলে পরিবেশেরও উন্নতি ঘটছে।’’
সূত্র : দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১২।০৪।১৪
শিশু দত্তক নেওয়ার জাতীয় তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান দ্বিতীয় – মহারাষ্ট্রের পরেই। খবরটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর অভাব থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সংসদে পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় দত্তক সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসার্চ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি ২০১১ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৪ –র মধ্যে এই রাজ্যে ১৪৬৬টি শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। এই একই সময়ে তালিকার শীর্ষে থাকা মহারাষ্ট্রে ৪২০৮টি শিশু দত্তক নেওয়া হয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা কর্ণাটকে এই সংখ্যা ১৩১৩।
পরিকাঠামোর নিরিখে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিবঙ্গের মধ্যে ফারাক বিস্তর। সারা মহারাষ্ট্রে ছড়িয়ে আছে ৬৮টি দত্তক সংস্থা। ওই রাজ্যে মহিলা ও শিশু কল্যাণ দফতরটি সক্রিয় হওয়ার দরুণ রাজ্যের সবক’টি দত্তক সংস্থা যথেষ্ট সংগঠিত। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৪টি দত্তক সংস্থা অবস্থিত এবং এগুলির প্রত্যেকটি কলকাতায়। অনাথ আশ্রম এবং হাসপাতাল, বিশেষত যেগুলি জেলায় অবস্থিত, সেগুলির সঙ্গে এই দত্তক সংস্থাগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ জোরালো নয়।
পশ্চিমবঙ্গের এই সাফল্যের প্রধান কারণ সম্ভবত দত্তক নেওয়ার প্রশ্নে এই রাজ্যের মানুষ প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। কিছু কাল আগে অবধি দত্তক নেওয়ার প্রশ্নে যে লজ্জা, সংকোচ ও কলঙ্কের মনোভাব দেখা যেত, তা সারা দেশেই অনেকাংশে কমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে তা আর নেই বললেই চলে। এই উদার মনোভাবের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করা এবং আইনগত খুঁটিনাটি দিকগুলিও এখানে অনেক তাড়াতাড়ি এবং সহজে সম্পূর্ণ করা সম্ভব হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার ও আদালতগুলিও যথেষ্ট সহযোগী। আর একটি খুব উত্সাহব্যঞ্জক দিক হল, এই রাজ্যে দত্তক নেওয়ার প্রশ্নটি প্রায় পুরোপুরি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ।
এপ্রিল ২০১৩ থেকে জুন ২০১৪-এর মধ্যে ২৪৪টি কন্যা সন্তান এবং ১৬৯টি পুত্রসন্তান দত্তক নেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এমন কী শারীরিক সমস্যা আছে এমন শিশু দত্তকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বিচার একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কোথাও কোথাও এ ব্যাপারে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
সূত্র : দ্য টেলগ্রাফ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৪
বয়্স্কদের সমস্যাটি শুধু স্বাস্থ্য বা অর্থনৈতিক নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও। আইন করে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক উদ্যোগেরও বিশেষ ভূমিকা থেকে যায়। যে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজেরাই ওল্ড এজ হোমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরাও নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রধান সমস্যা অবশ্যই সংযোগের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ তাঁদের ভালমন্দের বিষয়টি কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছবে সেটাই প্রধান সমস্যা। পৌঁছনো মানে শুধু বার্তাটুকু কানে যাওয়া নয়। এর একটি কার্যকরী দিকও রয়েছে। তাঁদের সমস্যার কথা এমন মানুষের কাছেই পৌঁছে দিতে হবে যাঁরা সমস্যার সমাধান করাটা জীবনের ব্রত বলে মনে করেন। সে ক্ষেত্রে সংযোগ তৈরি করার একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সম্প্রতি কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বৃদ্ধাদের নিয়ে একটি সামাজিক সংযোগমূলক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। যে সংগঠনের মূল কাজ হল এ ধরনের মানুষের মনের সমস্যার দিকটির ওপর গুরুত্ব দেওয়া। একাকিত্বের সঙ্কটের সঠিক সমাধান। একাকিত্বের সমস্যাকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে গোটা সমাজেরই এ ব্যাপারে কিছু করার দায়িত্ব থেকে যায়। শিশুদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব নিয়ে এ পর্যন্ত বহু কাজ হলেও বয়স্কদের ক্ষেত্রে,বিশেষ করে বয়স্কা মহিলাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার সমাধান হয়নি। তবে প্রচেষ্টা চলছে পুরোদমে।
ফৌজদারি মামলা না মেটা পর্যম্ত পুতুলদেবী জয়সওয়ালের যাবতীয় নিরাপত্তার ব্যবস্হা করতে দমদম ক্যান্টনমেন্ট থানাকে নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট৷ পুতুলদেবীর বয়স ৭২৷ তাঁর পুত্র আশিস, পুত্রবধূ ফুলকুমারী ও নাতি অমিতের বিরুদ্ধে পুতুলদেবীকে নির্যাতন ও বাড়ি ছাড়া করার অভিযোগ৷ দমদম ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় পুতুলদেবী থাকেন৷ তাঁরই বাড়ি থেকে নাকি পুত্র ও পুত্রবধূ তাঁকে মেরে বার করে দিয়েছেন৷ কারণ সেই বাড়ির দখল চান তাঁরা৷ থানায় অভিযোগ জানিয়েও কিছু হয়নি৷ কলকাতা হাইকোর্টে পুলিসি নিষ্ক্রিয়তার মামলা করেছিলেন ওই বৃদ্ধা৷ নির্যাতিতার পক্ষে আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরি বিচারপতি সৌমিত্র পালের এজলাসে সওয়াল করেন৷ হাইকোর্ট প্রথমে পুলিসের কাছে রিপোর্ট চেয়েছিল৷ সোমবার পুলিস জানিয়েছে আগাম জামিন নিয়েছে আশিস ও ফুলকুমারী৷ অমিতকে ওই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বিচারপতি পুতুলদেবী যাতে বাড়িতে ফিরতে পারেন তার ব্যবস্হা করতে বলেছেন৷ এমনকী ফৌজদারি মামলা না মেটা পর্যম্ত নিরাপত্তার ব্যবস্হাও করতে বলেছেন৷
সূত্র : আজকাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
অর্ধেক আকাশ নয়। পুরুষের সঙ্গে আকাশ ভাগাভাগি নয়। পুরো উড়ানপথেই বিমানের রাশ নারীর হাতে। নিরঙ্কুশ নারী-নিয়ন্ত্রিত উড়ান।
নতুন নয়। সূচনা হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। সে-দিন তাঁরাই ছিলেন নারী দিবসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নারী-উড়ানের দুই নিয়ন্তা। ক্যাপ্টেন নিবেদিতা ভাসিন আর ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নাগরাত। আড়াই যুগ পরে, রবিবার আর এক নারী দিবসে সেই জুটির হাতে বিমানের রাশ। সে-বার সফর ছিল ছোট্ট বিমানে, ছোট্ট পথে। এ বার এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশান্তরে পাড়ি। বিশাল বিমানে। ১৯৮৫। তখন ছোট ফকার বিমান চালাত এয়ার ইন্ডিয়া। তখন সংস্থার নাম ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স। সে-বার সরকারি ওই বিমান সংস্থার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, নারী দিবস উপলক্ষে ছোট্ট ফকার উড়বে শুধু নারী পাইলটদের হাতে। বিমানের অন্য কর্মীদের মধ্যেও পুরুষ রাখা হবে না। বিমানসেবিকা তো বটেই, অন্য কর্মীরাও হবেন মহিলা। সেই বিমানটি কলকাতা থেকে শিলচর উড়ে যায়। সাবেক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, এখনকার এয়ার ইন্ডিয়ার দাবি, সেটাই ছিল পৃথিবীর পুরোপুরি মহিলা কর্মী ও পাইলট নিয়ন্ত্রিত প্রথম উড়ান।
আকাশে নারীর আপন ভাগ্য জয়ের সেই দিনটিকে স্মরণ করা হয় প্রতি বছরই। তার পর থেকে ফি-বছর নারী দিবসে পুরুষ বাদ দিয়ে এ ভাবে মহিলা পাইলট ও সেবিকাদের নিয়ে উড়ান চালানোটা রীতিমতো রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রবিবার একটি তথ্য চমকে দেয় এয়ার ইন্ডিয়া-সহ উড়ান মহলকে। এ দিন ওই বিশেষ উড়ানের প্রস্তুতি পর্বে প্রায় আবিষ্কারের মতো আচমকাই জানা গেল, ১৯৮৫ সালের প্রথম নারী-উড়ানের দুই সদস্যা এ বারেও এক সঙ্গে উড়ছেন! মিলের সঙ্গে অমিলও অবশ্য আছে। সে-বার ক্যাপ্টেন ভাসিন আর ক্যাপ্টেন নাগরাত উড়েছিলেন কলকাতা-শিলচর রুটে। এ বার দিল্লি থেকে মেলবোর্ন হয়ে সিডনির মতো দীর্ঘ রুটে তাঁদের উড়ান। সে-বার তাঁদের হাতে ছিল ছোট্ট বিমান ফকারের রাশ। এ বার ওই জুটির উপরে বিশাল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের ভার।
বিমান সংস্থা সূত্রের খবর, নিবেদিতা আর লক্ষ্মী পাইলট হিসেবে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে যোগ দেন ’৮৫-তেই। পুরুষ পাইলট ও কর্মী-বর্জিত কলকাতা-শিলচর উড়ানের ভার দেওয়া হয় দুই নবাগতার হাতে। এখন তাঁদের বয়স বেড়েছে। বেড়েছে অভিজ্ঞতা। দেখা গেল, এ বার বেড়েছে তাঁদের উড়ানপথের দৈর্ঘ্য আর বিমানের আয়তনও। এয়ার ইন্ডিয়ার এক কর্তার কথায়, “ওঁরা দু’জনে যে এর মধ্যে আর এক সঙ্গে ওড়েননি, তা নয়। অনেক উড়েছেন। তবে নারী দিবস উপলক্ষে পুরোপুরি মহিলা নিয়ন্ত্রিত উড়ানে আবার দু’জনে ককপিটে পাশাপাশি বসলেন এত দিনে। ৩০ বছর পরে।”
এ দিন মুম্বই থেকে মাসকট এবং মুম্বই-দিল্লি উড়ানও নিয়ে গিয়েছেন শুধু মহিলা পাইলট আর কর্মীরা। মহিলা পাইলট আর বিমানসেবিকারা দায়িত্ব নিয়েছিলেন দিল্লি-জোধপুর-মুম্বই উড়ানেরও। এয়ার ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, পাইলট ও সেবিকা মিলিয়ে তাদের মহিলা কর্মীর সংখ্যা ৪৫০০। এ দিন সকালে দিল্লি ও মুম্বইয়ে ওই মহিলা-উড়ানগুলি ছাড়ার সময় শুধু মহিলা ইঞ্জিনিয়ার আর প্রযুক্তিবিদদের দিয়েই কাজ করানোর চেষ্টা হয়েছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া মহিলাদের উন্নয়নের জন্যও তারা আলাদা ভাবে কাজ করছে বলে এয়ার ইন্ডিয়ার দাবি।
নারী দিবসে পুরোপুরি মহিলা নিয়ন্ত্রিত ১৬টি বিশেষ উড়ান চালিয়েছে স্পাইসজেটও। যেখান থেকে (‘ফ্লাইট সাপোর্ট সেন্টার’) সংস্থার উড়ানসূচি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এ দিন সেখানেও কাজ করানো হয়েছে শুধু মহিলাদের দিয়ে। সংস্থা সূত্রের খবর, নারী দিবসের প্রথম বিশেষ উড়ানটি ভোর ৪টেয় চেন্নাই থেকে ছেড়ে কলম্বো যায়। তার পরে সারা দিনে আরও ১৫টি উড়ান গিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংস্থার দাবি, এই মুহূর্তে ভারতের অন্যান্য বিমান সংস্থার তুলনায় তাদেরই সব চেয়ে বেশি মহিলা পাইলট রয়েছেন।
নারী দিবসে সরকারি আর বেসরকারি দুই উড়ান সংস্থার মহিলাদের দাপট বুঝিয়ে দিয়েছে, আকাশ যতটা পুরুষের, ততটাই নারীর। এবং অর্ধেক নয়। পুরোটাই।
সূত্র : সুনন্দ ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ মার্চ ২০১৫
ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা
দুর্গাপুর একরত্তি মেয়েটা ছিল একটু বেশিই চঞ্চল৷ আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের থেকে দৌড় ঝাপেও থাকত এগিয়ে৷ স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও ছিল চরম আগ্রহ৷ খেলাধুলার আগ্রহটাই যে মেয়েকে শয্যাশায়ী করে দেবে তা ভাবতে পারেননি মা মালা চৌধুরী৷ কাঁকসা থানার পূর্ব ক্যানাল পাড়ের বাসিন্দা মালাদেবীর মেয়ে বছর ১৫ -র সৌমী৷ স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় লংজাম্পে অংশ নিয়ে ঝাঁপ মারতে গিয়ে বুকে আঘাত পায় সে৷ পরে হূদযন্ত্রে ত্রুটি ধরা পড়ায় শৈশবের স্বভাবিক ছন্দটাই হারিয়ে গিয়েছে তার জীবনে৷ বাবা মণিলাল চৌধুরী আগেই মারা গিয়েছেন৷ কাজ করার ক্ষমতা হারিয়েছেন অসুস্থ মা৷ এই অবস্থায় অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে জীবন -মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন পাঞ্জা লড়ছে ক্যানালপাড়ের ছোট্ট মেয়েটা৷ যদিও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সৌমীর স্কুলের শিক্ষক রামাধর পাণ্ডে৷ নিজে পাঁচ হাজার টাকা ও স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছ থেকে আরও সাত হাজার টাকা তুলে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন রামাধর৷ চিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছে ব্লক প্রশাসনও৷ কিন্ত্ত দিন দিন মেয়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে৷
শনিবার রাতে সৌমীর শরীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ তবে অতিরিক্ত রোগী থাকায় সারা রাত বারান্দায় কাটাতে হয়েছে তাকে৷ শিক্ষক রামাধর বলেন, ‘আমি আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছি৷ যেভাবেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে৷ দক্ষিণের একটি হাসপাতালের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি৷ তারা বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাতে রাজি হয়েছে৷ কিন্ত্ত যাতায়াত ও থাকার জন্য অন্তত ৫০ হাজার টাকা লাগবে৷ সেই টাকা সংগ্রহ করছি৷ ’পানাগড় হিন্দি স্কুলে পড়ত সৌমী৷ পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় লংজাম্পে অংশ নেয় সে৷ দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিতেই বুকটা গিয়ে পড়ে একটা পাথরের উপর৷ মারাত্মক আঘাত লাগে৷ অভাবের সংসারে সেভাবে চিকিৎসা হয়নি৷ বছর ঘুরতেই বুকের ব্যামোটা মাঝে মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠতে শুরু করে৷ পরিস্থিতি এমন জায়গায় যে স্কুলে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়৷ এদিক ওদিক থেকে কিছু টাকা জোগাড় করে মেয়েকে নিয়ে চিকিত্সকের কাছে দৌড়ন মালা৷ চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে জানিয়ে দেন, হৃদযন্ত্রে র একটি ভালভ অকেজো হয়ে গিয়েছে৷ অন্যের বাড়িতে কাজ করে সামান্য যা আয় করতেন তা দিয়ে কোনও রকমে সংসার চালাতেন মালা৷ সম্প্রতি তাঁর পেটে টিউমার হওয়ায় কাজের শক্তি হারিয়েছেন৷ সৌমীদের বাড়িতে অভাব আর রোগটা যেন থাবা গেড়ে বসেছে৷ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন মালা৷ ভালভ বদল না করলে সৌমীকে বাঁচানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিত্সকরা৷ হাসপাতাল সুপার দেবব্রত দাস অবশ্য সৌমীর সুচিকিৎসার আশ্বাস দিয়েছেন৷ মালাদেবী বলেন, ‘ঘরে কোনও জিনিস অবশিষ্ট নেই৷ মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব বিক্রি করে দিয়েছি৷ ডাক্তার বলছে দু’লক্ষ টাকা লাগবে৷ কোথা থেকে জোগাড় করব জানি না৷’ কাঁদতে কাঁদতে মালা বলেন, ‘চোখের সামনে মেয়ের মৃত্যু দেখা ছাড়া কোনও উপায় নেই৷’ শনিবার রাতে সৌমীর শরীরিক অবস্থার অবনতি হলে কাঁকসার বিডিও অরবিন্দ বিশ্বাসের উদ্যোগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ অরবিন্দ বলেন, ‘আমি খবর পাওয়া মাত্র বিএমওএইচকে নির্দেশ দিয়েছিলাম অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে মেয়েটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে৷ ব্লক প্রশাসনের তরফে যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করব৷
সুত্র: এই সময়
‘প্রিয়া’য় সিনেমা দেখতে যাননি কলকাতায় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার৷ ফিল্ম দেখা আর হল থেকে বেরিয়ে আসার মাঝে কখনও লক্ষ্য করেছেন কি এই সিনেমা হলে রয়েছে একটি ড্রপ বক্স? দেখে থাকলে ভেবেছেন কি কোন উদ্দেশ্যে রয়েছে সেটা? আদতে এই ড্রপ বক্সটি হল ‘মেডিসিন বক্স’৷
ঠিক যেমন আমাদের বাড়িতে থাকে৷ তবে এই মেডিসিন বক্সের উদ্দেশ্যটা একটু অন্য৷ এটা এমন এক উদ্যোগ যাতে উপকৃত হতে পারেন প্রকৃত অর্থেই যাঁদের দামী ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই তাঁরা৷ কী রকমভাবে ? প্রিয়া এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড (পিইপিএল)-এর তরফে ম্যানেজিং ডিরেক্টর অরিজিত্ দত্ত জানাচ্ছেন, ‘অনেক সময়ই আমরা যে ওষুধ কিনি তা পুরোটা খাই না৷ সুস্থ হয়ে গেলেই ওষুধ খাওয়ার ইচ্ছে চলে যায়৷ তাই বাকিটা আমরা ফেলে দিই, নষ্ট করি৷ কিন্ত্ত সেই ওষুধই হয়তো অন্য কেউ কিনতে পারছেন না টাকার অভাবে৷ তাই আমরা এই উদ্যোগটা নিই৷ একজনের কাছ থেকে নিয়ে অন্যজনকে সেটা পৌঁছে দেওয়ার৷’ যে কেউ এখানে ওষুধ ডোনেট করতে পারেন৷ যাতাযাতের পথে অব্যবহারের ওষুধটা বাড়িতে নষ্ট না করে প্রিয়ার এই ড্রপ বক্সে ফেলে গেলেই হবে৷ পিইপিএল -এর তরফে দেখে নেওয়া হয় এক্সপায়ারি ডেট অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে কিনা৷ প্রাথমিক স্ক্রিনিং -এর পর তা তুলে দেওয়া হয় এনজিওর হাতে৷ ‘বলাকা’ নামে একটি স্বেচ্ছসেবী সংস্থা প্রথমে এই ওষুধ পৌঁছে দেয় বিভিন্ন জেলায়৷ অন্য কোনও স্বেচ্ছসেবী সংস্থা নিতে ইচ্ছুক হলে তাদেরও দেওয়া হয়৷ এখন প্রায় পনেরোটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এখান থেকে ওষুধ নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গে , যাঁদের এই ওষুধ প্রয়োজন তাঁদের কাছে পৌঁছে দেয়৷ শুধু কলকাতায় নয়, যেখানে পিইপিএল-এর সংস্থা রয়েছে, সেখানেই রয়েছে ‘মেডিসিন বক্স’৷ সম্প্রতি ত্রিপুরাতেও শুরু হয়েছে এই উদ্যোগ৷ গত বছর পয়লা বৈশাখে এই ‘মেডিসিন বক্স ’ শুরু করার কথা প্রথম মাথায় আসে পিইপিএল -এর চেয়ারপার্সন পুর্ণিমা দত্তের৷
তারপরেই শুরু হয় তোড়জোড়৷ অরিজিত্ জানাচ্ছেন , ‘আমার মা প্রথম এই উদ্যোগ শুরু করতে চান৷ এরপর আমার স্ত্রীও অংশ নেন৷ ওঁরাই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন৷ প্রথমিক আলোচনার পর শুরু হয় এই উদ্যোগ৷ আমাদের কাজ ছিল অনবরত মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো৷ যাতে তাঁরা অব্যবহূত ওষুধ ফেলে না দিয়ে আমাদের ড্রপ বক্সে দিয়ে যান ’৷ শুরুর দিকে জেলার সিঙ্গল স্ক্রিন গুলোয় তেমন সাড়া পাওয়া যেতো না৷ কিন্ত্ত ক্রমশ পরিস্থিতি বদলেছে৷ তাহলে এখন মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন? তাঁরা কতটা সাহায্য করতে উত্সাহী? ‘এখন আমরা খুব ভালো রেসপন্স পাচ্ছি৷ অনেক মানুষ নিজে থেকে এসে ওষুধ দিয়ে যান৷ তাঁরা বুঝতে পেরেছেন তাঁদের এই সামান্য উদ্যোগ মানুষের কত উপকারে লাগে৷ আমরাও খুশি এভাবে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে থাকতে পেরে ’- জানাচ্ছেন অরিজিত্৷ এই উদ্যোগ যাতে আরও মানুষের কাছে পৌঁছায় , আরও জনপ্রিয়তা পায় তার জন্যে শুরু হয়েছে স্লাইড শো৷ পিইপিএল -এর যে কোনও হলেই দেখতে পাবেন নোটিস বোর্ডও৷ যাঁরা জানেন না সহজেই যাতে তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় এই উদ্যোগের কথা৷
তথ্যসূত্রঃ দেবলীনা ঘোষ মুখোপাধ্যায়, এই সময়
যৌনকর্মী, ক্ষমতায়ন - কোনওটাই খুব প্রচলিত শব্দ নয়। আগে যাঁদের বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, বারাঙ্গনা, দেহোপজীবিনী, বারবণিতা ইত্যাদি নামে বলা হত, গত দশ-পনেরো বছর ধরে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের যৌনকর্মী নামে উল্লেখ করা হচ্ছে। আজকাল পৃথিবীর সব দেশেই তাঁরা নিজেদের সেক্স ওয়ার্কার বা এর কোনও প্রতিশব্দে অভিহিত হতে চান, কারণ তাঁরা মনে করেন অন্যান্য পেশার মতই যৌনকর্মও একটি পেশা।
Empowerment-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সম্প্রতি 'ক্ষমতায়ন' শব্দটির ব্যবহার চালু হয়েছে, বিশেষভাবে নারীর ক্ষমতাকে পুরুষের ক্ষমতার সমতুল্য করার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। যৌনকর্মীদের বেশীরভাগই নারী এবং ক্ষমতার মাপকাঠিতে নারীদের মধ্যেও তাঁদের অবস্থান সবচেয়ে নীচের দিকে। নারীর ক্ষমতায়ন সম্বন্ধে গত তিন-চার দশকে প্রভূত পরিমানে লেখালেখি হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের কথা এই যে যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রায় কিছুই লেখা হয় নি, কোনও দেশেই। ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের কিছু অঞ্চলের যৌনকর্মীরা সঙঘবদ্ধ হয়ে তাঁদের শোচনীয় অবস্থা ও অসহায়তা থেকে বেরিয়ে নিজেদের ন্যায্য মানবিক অধিকারের বা ক্ষমতায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য তারই একটু আভাস দেওয়া।
ভারতের পুরাণ, মহাকাব্য, জাতক সংহিতা, বাত্স্যায়নের কামসূত্র, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি সাহিত্যে যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে কিছু বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বৃটিশ আমলে কলকাতা, চেন্নাই. মুম্বাই ইত্যাদি শহরের নথিপত্রে এবং বিংশ শতাব্দীতে লেখা অনেক গল্প-উপন্যাসে যৌনকর্মীদের জীবন-যাপনের কিছু বিবরণ পাওযা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের ভারতের যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে অনুসন্ধানমূলক তথ্যাদি খুবই সীমিত।
গত দু-দশকে এড্স নিবারণের উদ্দেশ্যে ভারতের কয়েকটি লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে বিশেষ প্রকল্প শুরু হয়েছে ও সেই সূত্রে তাঁদের জীবনযাত্রা, পেশাগত কার্যকলাপ, নানাবিধ সমস্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে তথ্যাদি সংগ্রহ করে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু লালবাতি এলাকার বাসিন্দা ছাড়াও ভারতে আরও অনেক রকমের যৌনকর্মী আছেন। তাঁদের সংখ্যাই অনুপাতে বেশী। উপরোক্ত রিপোর্টগুলি ছাড়া, ভারতের যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে আরও যেসব তথ্যাদি বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ, পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, নীচের বিবরণটি তারই ভিত্তিতে লেখা।
ভারতে আনুমানিক ২৫ - ৩০ লক্ষ যৌনকর্মীদের মোটামুটি এই কয়েকটি শ্রেণীরে ভাগ করা যায়: (১) লালবাতি এলাকার ভেতরে বা বাইরে যৌনকর্মালয়ে (ব্রথেল-এ) বসবাসকারী যৌনকর্মী; (২) পথচারী বা ভাসমান (ফ্লোটিং) যৌনকর্মী; (৩) ছোটবেলায় পারিবারিক দারিদ্রের জন্য দেবদাসী হিসেবে উত্সর্গীকৃত মেয়েরা যাদের বেশীর ভাগকেই পরে যৌনকর্মী হতে হয়; (৪) যাযাবর শ্রেণীর যেসব মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই যৌনকর্মী হওয়ার তালিম দেওযা হয় এবং পরে পারিবারিক অভাব মেটাবার জন্য যৌনকর্মে নিযুক্ত করা হয়; (৫) যেসব মেয়েদের পূর্বপুরুষরা প্রথাগতভাবে পারিবারিক ভরণ-পোষণের জন্য মেয়েদের নাচগান পরিবেশনের উপর নির্ভর করতেন, তাঁদের অনেকে আজকাল বাঈজী, নাচনী ইত্যাদি নামে যৌনকর্মে নিযুক্ত থাকেন; (৬) কলগার্ল, যাঁদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত এবং নিজেদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবার জন্য আংশিক বা পুরোভাবে যৌনকার্যে নিযুক্ত থাকেন; (৭) পুরুষ বা হিজড়ে যৌনকর্মী যাঁরা টাকার বিনিময়ে প্রধানতঃ সমকামী বা উভয়কামী পুরুষদের যৌনক্ষুধা মেটান এবং (৮) শিশু যৌনকর্মী যারা কলগার্ল ছাড়া উপরের সব শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত এবং যাদের বেশির ভাগই ট্র্যাফিকিং-এর মর্মান্তিক শিকার।
বেশীর ভাগ যৌনকর্মীকেই ছলে-বলে-কৌশলে যৌনকার্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কেউ কেউ দৈব-দুর্বিপাকে এমন চরম দুর্দশার মুখে পড়েছেন যে নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে যৌনপেশায় যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বিরূপতা বা ঘৃণা এত গভীর ও ব্যাপক যে, যাঁর উপর একবার যৌনকর্মীর ছাপ পড়ে যায় তাঁর পক্ষে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার কোনও উপায় থাকে না। ন্যুনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে চরম দারিদ্রে, জঘন্য পরিবেশে নানাভাবে নিপীড়িত হয়ে তাঁকে বেঁচে থাকতে হয়।
ভারতের বেশীর ভাগ যৌনকর্মী কোনও না কোনও যৌনরোগে প্রায়ই ভোগেন। আজকাল তাঁদের অনেককেই অ্যাণ্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু যৌন-সংসর্গের মাধ্যমে এইচ-আই-ভি নামক ভাইরাস শরীরে সংক্রামিত হলে যে জীবন-নাশক এড্স রোগের উত্পত্তি হয়, তার কোনও প্রতিষেধক টিকা বা আরোগ্যকর ওষুধ এখনও বেরোয় নি। যৌনকর্মীরাই এড্স-এর সবচেযে বড় শিকার, কারণ নিছক জীবিকার জন্য তাঁদের অনেক খদ্দেরকে যৌনতৃপ্তি দিতে হয় এবং বেশীর ভাগ খদ্দের কণ্ডোম ব্যবহার করতে চান না।
এড্স-নিবারণ প্রকল্পের সহায়তায় যে সব যৌনকর্মীরা কণ্ডোম ব্যবহারের অপরিহার্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন তাঁরাও দারিদ্রের কারণে কণ্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। সেজন্য ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকার যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ-আই-ভি/এড্স-এর প্রসার ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে গেছে এবং তার ফলে তাঁদের খদ্দেরদের মধ্যেও বাড়ছে। এইচ-আই-ভি আক্রান্ত খদ্দেরদের মাধ্যমে তাঁদের স্ত্রীদের শরীরেও এই ভাইরাস সংক্রামিত হচ্ছে। আবার স্ত্রীদের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সন্তান এই ভাইরাসের শিকার হচ্ছে।
১৯৯০ দশকের প্রথম থেকে ভারতের কিছু শহরের লালবাতি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ-আই-ভি/এড্স নিবারক প্রকল্প কার্যকারী হয়। কলকাতার সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় ১৯৯২ সালে। এই প্রকল্পের একটি অঙ্গ হিসেবে ঐ এলাকার কিছু বাছাই করা যৌনকর্মীকে এইচ-আই-ভি/এড্স, কণ্ডোম ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়ে 'পিয়ার এডুকেটর' হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। রোজ কিছু সময় অন্যান্য যৌনকর্মীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাঁদের এইচ-আই-ভি/এড্স সম্বন্ধে সচেতন করো ও কণ্ডোম ব্যবহারের পদ্ধতি ইত্যাদি শিখিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে একটি মাসোহারা বরাদ্দ করা হয়।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পিয়ার এডুকেটররা বুঝতে পারলেন যে, যৌনকর্মীরা তাঁদের খদ্দেরদের সঙ্গে যৌন সংসর্গের সময়ে কণ্ডোম ব্যবহার করতে যথেষ্ট আগ্রহী হলেও, খদ্দেররা সাধারণভাবে তা করতে একেবারেই অনিচ্ছুক। এটাও বুঝতে পারলেন যে, কোনও যৌনকর্মী তাঁর কণ্ডোন ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক খদ্দেরকে প্রত্যাখ্যান করলে, সেই খদ্দেরের পক্ষে একটু বেশী টাকা খরচ করলে কণ্ডোম ব্যবহার না করেই যৌন সংসর্গে রাজী এরকম যৌনকর্মীকে আশেপাশেই পাওয়া শক্ত হয় না। ফলে কণ্ডোমের ব্যবহারের অনুপাত প্রায় কিছুই বাড়ছিল না।
এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্যে সোনাগাছির পিয়ার এডুকেটররা, প্রকল্পের ডাক্তার, সমাজসেবিকা ইত্যাদির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলেন যে, ওখানকার যৌনকর্মীদের সঙঘবদ্ধ হতে হবে এবং তাঁদের খদ্দেরদের কাছে দলবদ্ধভাবে কণ্ডোম ব্যবহারের দাবী করতে হবে। পিয়ার এডুকেটরদের উদ্যোগে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি (সংক্ষেপে দুর্বার) নামে যৌনকর্মীদের একটি সংস্থা তৈরী হল। এই সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষণা করা হল যে, যৌনকর্মকে একটি ন্যায্য পেশার স্বীকৃতির দাবী করা, সাধারণ নাগরিকদের যেসব ন্যুনতম অধিকার আছে যৌনকর্মীদের পক্ষ থেকে সেসব অধিকার দাবী করা এবং এইসব অধিকার আদায় করার জন্য সঙঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করে যাওয়া।
প্রথম লড়াই শুরু হল খদ্দেরদের সঙ্গে যাতে তাঁরা যৌন সংসর্গে কণ্ডোম ব্যবহার করেন। খদ্দেররা যখন দেখলেন যে কণ্ডোম ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক বলে কোনও যৌনকর্মীর কাছে প্রত্যাখ্যত হলে আশেপাশের সব যৌনকর্মীর কাছ থেকেই তিনি একই কারণে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন - বেশী টাকা দিতে চাইলেও, তখন তাঁরা কণ্ডোম ব্যবহার করতে রাজী হতে থাকলেন। এর ফলে সোনাগাছি এলাকায় যৌনকর্মীদের মধ্যে কণ্ডোম ব্যবহার বেশ দ্রুত হারে বাড়তে থাকল এবং তাঁদের যৌনরোগের সংক্রমণ কমতে থাকল। এইচ-আই-ভি আক্রান্তের সংখ্যাও ভারতের অন্যান্য জায়গার যৌনকর্মীদের মধ্যে যতটা বাড়তে থাকল, সোনাগাছিতে ততটা বাড়ল না। ২০০৬ সালে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ-আই-ভি আক্রান্তের অনুপাত শতকরা ৬-এর মত, কিন্তু মুম্বাই-এর কামাতিপুর এলাকায় শতকরা ৫০-এর বেশী এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক জায়গায় শতকরা ৩০-এর বেশী।
সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচ-আই-ভি আক্রান্তের অনুপাত অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ হল তাঁদের খদ্দেরদের কণ্ডোম ব্যবহার করতে রাজী বা বাধ্য করার ক্ষমতা তৈরী হয়েছে বলে। দুর্বারের নানাবিধ কার্যক্রম মাধ্যমে তাঁরা জীবনের অন্যান্য আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও ক্ষমতায়নের দিকে এগিযেছেন। এর একটা প্রধান উদাহরণ হল উষা কো-অপরেটিভ নামে নিজেদের একটি সমবায় সংস্থার সৃষ্টি করে স্থানীয় সূদখোর কুসীদজীবিদের শোষণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া। যৌনকর্মীদের অনেকেই দৈনিক রোজগার থেকে কিছু টাকা এই সংস্থায় জমা রাখেন এবং অসুখ-বিসুখ বা অন্য কারণে বাড়তি তাকার দরকার হলে এই সংস্থা থেকে অল্প-সূদে টাকা ধার করতে পারেন। উষা কো-অপরেটিভের সদস্য সংখ্যাপ্রায় ৭০০০ এবং সারা বছরে এর মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বেশী লেনদেন হয়।
স্থানীয় দালাল, গুণ্ডা ও অন্যান্য দুর্বৃত্তরা যারা আগে যৌনকর্মীদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাঁদের নানাভাবে নিপীড়িত করত, তাদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ আন্দোলনে তারা অনেকটা দমিত হয়েছে। নানা রকম সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা ইত্যাদি করে যৌনকর্মীরা তাঁদের ন্যায্য নাগরিক অধিকার প্রকাশ্যে দাবী করছেন। গত দু-দশকে দুর্বারের পক্ষ থেকে কলকাতায় চারটি যৌনকর্মীদের জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। সল্ট লেক স্পোর্ট্স স্টেডিযামে অুনষ্ঠিত প্রত্যেকটি সম্মেলনে ২০০০ - ৩০০০ যৌনকর্মী যোগ দিয়ে তাঁদের নানাবিধ সমস্যার কথা আলোচনা করেছেন এবং সর্বসমক্ষে নিজেদের দাবী প্রকাশ করেছেন।
দুর্বারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের অন্যান্য কিছু এলাকার যৌনকর্মীরাও তাঁদের নিজস্ব সংস্থা গড়ে তুলেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: পঞ্চম (বিহার), সাভেরা (দিল্লী, উত্তর প্রদেশ ও বিহার) , সেক্স ওয়ার্কার্স ফোরাম (কেরল), বেশ্যা এড্স মুকাবিলা পরিষদ (মহারাষ্ট্র) এবং উইমেন্স ইনিশিয়েটিভ (তিরুপতি)।
ভারতে যৌনপেশা সম্পর্কীত এখন যে আইন চালু আছে (ইম্মরাল ট্র্যাফিক প্রিভেন্শন অ্যাক্ট, ১৯৫৬), তার সংশোধনের জন্য ভারত সরকার সম্প্রতি যে প্রস্তাবের খসরা তৈরী করেছে, তার প্রতিবাদের দুর্বার এবং উপরোক্ত সংস্থার প্রায় ৪০০০ যৌনকর্মী প্রতিনিধি দিল্লীতে গত ৩ থেকে ৮ মার্চ সমবেত হন এবং সভা-সমিতি, র্যালি , পথনাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেন। সবচেয়ে বেশী আপত্তি হল এই সংশোধনী প্রস্তাবের একটি ধারা সম্বন্ধে যাতে যৌনকর্মীর খদ্দেরদের আইনত অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেওযা হবে। ৮ মার্চ তাঁরা একটি শোভাযাত্রা করে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে একটি মেমোরাণ্ডাম পেশ করেন। সেটাতে তাঁরা এই সংশোধনী প্রস্তাবটি বিলোপ করা ও পিটা আইনের কিছু ধারার সংশোধন করার জন্য আবেদন করেন।
ভারতের লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মীদের পক্ষে সঙঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের নানাবিধ অধিকারের দাবী করা এবং ইতিমধ্যে অতি অল্প হলেও তার কিছুটা আদায় করা তাঁদের নিজেদের কাছে বা অন্যদের কাছেও ১৫ বছর আগে প্রায় স্বপ্নেরও অতীত ছিল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের কিছু দেশে যৌনকর্মীরা বেশ কয়েক বছর হল তাঁদের নিজেদের কিছু দাবী-দাওয়া আদায় করতে পেরেছেন। কিন্তু এইসব যৌনকর্মীরা ভারতের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের মত এত দরিদ্র, এত নির্যাতিত ও এত অসহায় কখনোই ছিলেন না। ভারতের যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়নের যে আন্দোলন শুরু হযেছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশের যৌনকর্মীদের পক্ষে পথ-প্রদর্শক হিসেবে গণ্য হবে।
তথ্য সংকলন: অবসর
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020