নারীদের ক্ষমতা
- নারী পুরুষ লিঙ্গসমতার কথা ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া মৌলিক অধিকার, মৌলিক কর্তব্য ও নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যেও বিষয়টি রয়েছে। সংবিধান নারীদের শুধু সমান অধিকারই দেয়নি, বৈষম্য ঘোচানোর জন্য রাষ্ট্রকে সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার দিয়েছে।
- গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে আমাদের আইন, উন্নয়নের নীতি, পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদর অগ্রগতির অভিমুখে কাজ করেছে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় থেকে (১৯৭৪-১৯৭৮) মেয়েদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এই পর্বে কল্যাণের চেয়ে নারীর উন্নয়নের প্রশ্নটিতে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিই নারীর অবস্থান বিচারে কেন্দ্রীয় বিচার্য বিষয়। ১৯৯০ সালে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে জাতীয় মহিলা কমিশন গঠন করা হয় যার উদ্দেশ্য মেয়েদের অধিকার ও আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। সংবিধানের ৭৩ এবং ৭৪ নম্বর সংশোধনীর (১৯৯৩) মাধ্যমে মেয়েদের জন্য পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও স্থানীয় প্রশাসনে আসন সংখ্যা সংরক্ষিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা অনেকটাই দৃঢ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
- ভারত নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণ ও মেয়েদের অধিকার দানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে সাক্ষর করেছে। এর মধ্যে মুখ্য হল— নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত ১৯৯৩-এর সনদে (‘দি কনভেনশন অন এলিমিনেশন অফ অল ফর্মস অফ ডিসক্রিমিনেশন এগেনস্ট উইমেন’) অনুমোদন দেওয়া।
- ভারত মেক্সিকো প্ল্যান অফ অ্যাকশন (১৯৭৫), দ্য নাইরোবি ফরওয়ার্ড লুকিং স্ট্রাটেজিস (১৯৮৫), দ্য বেজিং ডিক্লারেশন এবং তার অ্যাকশান প্ল্যান (১৯৯৫) এবং একবিংশ শতাব্দীর সাম্য, উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যে নেওয়া ইউএনজিএ অধিবেশনে গৃহীত দলিল ‘ফারদার অ্যাকশন অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভ টু ইমপ্লিমেন্ট দ্য বেজিং ডিক্লারশন অ্যান্ড দ্য প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন’-এ সম্মতি দিয়েছে এবং তা রূপায়ণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
- নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নেওয়া ভারতের নীতিগুলি নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।
- নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে এবং তৃণমূল স্তরে জোরালো উপস্থিতি রয়েছে এমন সব স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংযোগ এবং বিভিন্ন নারী আন্দোলন মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিকে ঘিরে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
- তা সত্ত্বেও সংবিধান, আইন, নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে যে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে এবং বাস্তব পরিস্থিতিতে নারীদের অবস্থান— এই দুইয়ের মধ্যে বিশাল ফারাক রয়ে গিয়েছে।
- এই বিষয়টি নিয়ে ‘কমিটি অন দি স্ট্যাটাস অফ উইমেন ইন ইন্ডিয়া’, ‘টুয়ার্ডস ইকোয়ালিটি’, ১৯৭৪-এ বিস্তৃত আলোচনা করেছে। ন্যাশানাল পারসপকটিভ প্ল্যান পর উইমেন ১৯৮৮-২০০০, দ্য শ্রমশক্তি রিপোর্ট ১৯৮৮ এবং ‘প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন, ফাইভ ইয়ার্স আফটার’-এ বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।
- লিঙ্গ বৈষম্য নানা ভাবে ফুটে ওঠে তা বোঝার সবচেয়ে প্রধান উপায় হল জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী গত কয়েক দশকে জনসংখ্যায় নারী-পুরুষ অনুপাত কমা। সমাজের তথৈবচ অবস্থা, সামাজিক ক্ষেত্রে ও বাড়িতে মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনা তার আরও একটি প্রমাণ। দেশের অনেক জায়গাতেই শিশু-কন্যা, নারী ও বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের প্রতি বৈষম্য আজও চলেছে।
- নারী বৈষম্যের অন্তর্লীন কারণগুলি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত। সেগুলি প্রচলিত ও অপ্রচলিত নিয়মের অঙ্গ।
- পাশাপাশি কমজোরি বর্গের মহিলা, যাঁরা বেশির ভাগ গ্রামে বসবাস করেন, যাঁরা অসংগঠিত শ্রেণিভুক্ত (এর মধ্যে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিও পড়ে), তাঁরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য ফলদায়ক সুবিধার সুযোগ নিতে পারছেন না। ফলে তাঁরা প্রান্তিক, গরিব ও সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছেন।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
এই নীতির লক্ষ্য নারীদের অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করা। এই নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং আগ্রহীরা লক্ষ্যপূরণে উৎসাহী হন।
এই নীতির উদ্দে্শ্যগুলি হল—
- এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে নারীরা যাতে তাঁদের পূর্ণ ক্ষমতা বুঝতে পারে। সে দিকে তাকিয়ে তাঁদের উন্নয়নে সদর্থক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নিতে হবে।
- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক— সমস্ত ক্ষেত্রে প্রকৃত ও বিধিসম্মত ভাবে নারীরা যাতে পুরুষদের সঙ্গে সমান মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করেন তার ব্যবস্থা করা।
- দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যাতে নারীরা সমান সুযোগ পান তার ব্যবস্থা করা।
- নারীরা যাতে স্বাস্থ্য, সর্বস্তরে উন্নত শিক্ষা, ভবিষ্যৎ জীবিকা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকনির্দেশ, কাজের সুযোগ, সমান বেতন, কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা, সরকারি দফতরে ঢোকার সুযোগ পান তার ব্যবস্থা করা।
- নারীদের প্রতি সব রকমের সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে জোরদার করা।
- নারী ও পুরুষদের সমান তালে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গোষ্ঠীগত অভ্যাস বদলানো।
- উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ সচেতনতাকে প্রাধান্য দেওয়া।
- নারী ও বালিকাদের উপর সব ধরনের হিংসা বন্ধ করা ও বৈষম্য দূর করা।
- নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে নারী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা ও তা সুদৃঢ় করা।
নীতিগত ব্যবস্থাপত্র
আইন ও বিচার ব্যবস্থা
- নারীদের চাহিদা অনুযায়ী, বিশেষ করে পারিবারিক হিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনায়, বিচার ও আইনি ব্যবস্থাকে আরও সংবেদনশীল ও লিঙ্গ-সচেতন করা হবে। নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে এবং পুরনো আইন সংস্কার করা হবে যাতে বিচার দ্রুত হয় এবং অপরাধীদের অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়।
- নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সমস্ত গোষ্ঠী, ধর্মীয় নেতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে ও পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, খোরপোষ ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত ‘পার্সোনাল ল’ বদল করতে উৎসাহ দেওয়া হবে।
- পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত নিয়মটিই নারীদের অধস্তন করে রেখেছে। নারী-পুরুষ সাম্য যাতে বজায় থাকে সে দিকে দৃষ্টি রেখে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হবে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ
- নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সবক’টি স্তর সহ সর্বত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় যোগদান ও ক্ষমতা ভাগ সুনিশ্চিত করা হবে। এর জন্য তাঁদের সমান অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। পরিষদীয়, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয়, কর্পোরেট, বিধিবদ্ধ সংস্থা, উপদেষ্টা কমিশন, কমিটি, পর্ষদ ও অছি পরিষদ সহ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নারীদের সমান ও পূর্ণ অধিকার সুনিশ্চিত করতে সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
- দরকার হলে, এমনকী উচ্চতর পরিষদীয় প্রক্রিয়াতেও সময় বেঁধে কোটা/ সংরক্ষণ চালু করার মতো সদর্থক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনা করা হবে।
- উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মেয়েরা যাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন তার জন্য নারী-বান্ধব নীতি গ্রহণ করা হবে।
উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় লিঙ্গ সচেতনতাকে প্রাধান্য দেওয়া
- নারীরা যাতে সব উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যোগ্য ভূমিকা পান তার জন্য নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। তাঁদের অনুঘটক, অংশগ্রহণকারী ও প্রাপকের ভূমিকা সুনিশ্চিত করা হবে। নীতি ও কার্যক্রমে ফাঁক থাকলে তা ভরাট করার জন্য নারীভিত্তিক সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নারীদের মূল স্রোতে আনার প্রক্রিয়া ঠিক ভাবে এগোচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নজরদারি চালানো এবং পুরোটা দেখভাল করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর ফলে নারীদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও ইস্যুগুলি সংশ্লিষ্ট আইন, বিভাগীয় নীতি, পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মধ্যে সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হবে এবং সেগুলি মেটানো হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন
দারিদ্র দূরীকরণ
পরিবারের অভ্যন্তরীণ অবস্থান এবং সামাজিক বৈষম্যের রূঢ় বাস্তব দিকটি মাথায় রেখে বলা যায়, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই মহিলা এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা চূড়ান্ত দারিদ্র ভোগ করেন। বড় ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি এ ধরনের নারীদের সমস্যার সমাধান করবে এবং তাঁদের চাহিদা পূরণ করবে। যে সব নারী-অভিমুখী কর্মসূচি চালু আছে সেগুলি আরও উন্নত ভাবে কার্যকর করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমস্ত পরিষেবা এক জায়গায় মেলাতে ও দরিদ্র নারীদের সন্নিবেশিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাঁদের নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা দেওয়া হবে এবং তাঁদের সক্ষমতা বাড়াতে উপযুক্ত সাহায্য জোগানো হবে।
ক্ষুদ্র ঋণ
ঋণ দেওয়ার পরিসর যাতে বাড়ানো যায় সেই লক্ষ্যে বর্তমানে চালু ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা ও ক্ষুদ্র আর্থিক সংস্থাগুলি শক্তিশালী করা হবে এবং নতুন সংস্থা চালু করা হবে যাতে নারীসমাজ উৎপাদন ও উপভোগের ক্ষেত্রে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী সমস্ত নারী যাতে সহজেই ঋণের সুযোগ পান তার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্কের পর্যাপ্ত ঋণপ্রদানের ক্ষেত্রে অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নারী ও অর্থনীতি
বৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি রূপায়ণে নারী-প্রেক্ষিতটির জায়গা করে দেওয়ার জন্য তাঁদের অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে উৎপাদক ও কর্মী হিসেবে তাঁদের অবদানকে প্রথাগত এবং অপ্রথাগত ক্ষেত্রে (ঘরের কাজ সমেত) স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং তাঁদের কাজের সুযোগ ও কাজের পরিবেশ সম্পর্কে যথাযথ নীতি গ্রহণ করা হবে।
এর মধ্যে রয়েছেঃ
- কর্মী ও উৎপাদক হিসেবে নারীর অবদান কতটা তা বোঝাতে কাজের চিরাচরিত ধারণার পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্সংজ্ঞায়িত করা হবে, যেমন জনগণনা রিপোর্টে।
- জাতীয় এবং স্থানীয় স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা হবে।
- প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার কাজগুলি করার ব্যাপারে উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে।
বিশ্বায়ন
বিশ্বায়ন নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্যের দিক দিয়ে এর প্রভাব পুরোপুরি মূল্যায়ন করা হয়নি। যাই হোক, কেন্দ্রীয় সরকারের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের করা তৃণমূল স্তরের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, নারীর জীবিকার সুযোগ ও জীবিকার মানোন্নয়নে নতুন পদক্ষেপ আবশ্যিক। বিশ্ব-অর্থনীতি প্রসারের সুফল বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে, দারিদ্রে মহিলাদের ভাগ বাড়ছে, অসংগঠিত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় নিরাপত্তাহীন কাজের পরিবেশ ও কাজের অবস্থার ক্রমাবনতিতে বাড়ছে লিঙ্গ বৈষম্য। বিশ্বায়নের নেতিবাচক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের মোকাবিলা করতে নারীদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
নারী ও কৃষি
কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রে উৎপাদক হিসেবে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওই সব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ সহ নানা কর্মসূচির সুফল যাতে তাঁদের কাছে সংখ্যার অনুপাতে ঠিকঠাক পৌঁছয় তা সুনিশ্চিত করতে সুসংহত উদ্যোগ নেওয়া হবে। কৃষি-সহযোগী শিল্প অর্থাৎ হর্টিকালচার, পশুপালন, পোল্ট্রি, মাছচাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মাটি সংরক্ষণ, সামাজিক বনসৃজন, দুগ্ধশালা উন্নয়ন ও অন্যান্য কাজে মেয়েদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করা হবে।
নারী ও শিল্প
- ইলেকট্রনিক্স, তথ্যপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, তাঁত ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এই সব ক্ষেত্রের উন্নয়নে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। শ্রম আইন, সামাজিক সুরক্ষা ও অন্যান্য সহায়ক পরিষেবায় তাঁদের সুসংহত সহায়তা দেওয়া হবে যাতে অন্য শিল্পেও তাঁরা অংশগ্রহণ করতে পারেন।
- ইচ্ছা থাকলেও মহিলারা এখন কারখানার রাতের শিফটে কাজ করতে পারেন না। যাতে তাঁরা রাতের শিফটে কাজ করতে পারেন তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা, পরিবহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য সহায়ক পরিষেবার ব্যবস্থা করা হবে।
সহায়ক পরিষেবা
উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে এবং সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীর পূর্ণ সহযোগিতা পেতে তাঁদের জন্য সহায়ক পরিষেবা আরও বিস্তৃত করা হবে যেমন, কাজের জায়গা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রেশের ব্যবস্থা সহ শিশু রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য হোমের ব্যবস্থা ইত্যাদি। নারী- সহায়ক কর্মী নীতি তৈরি করা হবে তাঁরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হন।
সামাজিক ক্ষমতায়ন
শিক্ষাক্ষেত্রে
মহিলা ও বালিকাদের শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। বৈষম্য ঘোচাতে, শিক্ষা সার্বজনীন করতে, নিরক্ষরতা দূর করতে, লিঙ্গ-সচেতন শিক্ষা পদ্ধতি তৈরি করতে, মেয়েদের শিক্ষাঙ্গনে এনে তাঁদের রেখে দেওয়ার হার বাড়াতে, শিক্ষার গুণমানের উন্নতি ঘটাতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে যাতে মেয়েরা সুদীর্ঘ শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে পারেন এবং কাজ/বৃত্তি/কারিগরী ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ক্ষেত্রে লিঙ্গ ফারাক কমানোর ওপর জোর দেওয়া হবে। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বিশেষ করে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির নারী ও বালিকাদের উপর বিশেষ জোর দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব করা হবে। লিঙ্গ বৈষম্যের অন্যতম কারণ হল লিঙ্গ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। এই সমস্যা দূর করতে শিক্ষার সমস্ত স্তরে লিঙ্গ-সচেতন শিক্ষাক্রম চালু করা হবে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে
নারীর স্বাস্থ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হবে যাতে নারী ও বালিকাদের জীবনচক্রের নানা পর্যায়ে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি ঘটে। মানবোন্নয়নের বড় দুটি ক্ষেত্র—শিশু ও প্রসূতি। এদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ২০০০ সালের জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে শিশু মৃত্যু হার (আইএমআর) ও প্রসূতি মৃত্যু হার (এমএমআর)-এর যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তাতে পৌঁছনোর ব্যাপারে নীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে। নারীরা যাতে সঠিক গুণমানের, স্বল্প খরচে, সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা উচিত। নারীর প্রজনন সংক্রান্ত অধিকার এবং পছন্দমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভিন্ন যৌনতা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সমস্যা, ছোঁয়াচে, জীবাণুঘটিত এবং সংযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এমন রোগ যেমন, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, জলবাহিত রোগ ইত্যাদি এবং হাইপার-টেনশন, হৃদরোগের ব্যাপারেও নারীদের সচেতন করা হবে। সমাজ, উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর এইচআইভি\এইডস ও অন্যান্য যৌন রোগের যে প্রভাব পড়ে, লিঙ্গ-নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার মোকাবিলা করা হবে।
- শিশু ও মায়েদের মৃত্যু এবং কম বয়সে বিয়ের সমস্যা কার্যকর ভাবে মোকাবিলা করার জন্য জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য যোগাড় করা দরকার। জন্ম ও মৃত্যুর নথিভুক্তকরণ কড়াকড়ি করা হবে এবং বিবাহ নথিভুক্তকরণ আবশ্যিক হবে।
- জনসংখ্যা সুস্থিত রাখার যে অঙ্গীকার ২০০০ সালের জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে করা হয়েছে, সে অনুযায়ী এই নীতি নারী ও পুরুষের নিজেদের পছন্দমতো নিরাপদ, কার্যকর ও সঙ্গতিসম্মত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেছে নেওয়ার অধিকার এবং বাল্যবিবাহ সমস্যা ও সন্তানের মধ্যে ব্যবধান রাখা সংক্রান্ত বিষয়টির ঠিকঠাক মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। শিক্ষার প্রসার, বিবাহের আবশ্যিক নথিভুক্তকরণ এবং বিএসওয়াইয়ের মতো বিশেষ কর্মসূচি বাল্যবিবাহ রোধ করতে যথেষ্ট সক্ষম।
- স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে মেয়েদের চিরায়ত জ্ঞানকে প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে নথিভুক্ত করে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং তা ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হবে। মেয়েদের জন্য লভ্য সার্বিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর মধ্যে ভারতীয় ও বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যবহার বাড়ানো হবে।
নারীর পুষ্টি
মেয়েদের জীবনচক্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অর্থাৎ শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল এবং প্রজনন সক্ষম হওয়ার স্তরে রোগ ও অপুষ্টির শিকার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এ কথা মাথায় রেখে জীবনচক্রের ওই তিন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মেয়েদের পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার দিকে নজর দেওয়া হবে। বয়ঃসন্ধিকালীন নারী, অন্তঃসত্ত্বা ও সদ্য মা হওয়া নারীদের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সদ্যোজাত শিশু ও বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপুষ্টির বৃহৎ ও ক্ষুদ্র কারণগুলি যাতে দূর হয় তার জন্য বিশেষভাবে জোর দেওয়া হবে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও সদ্য মা হওয়া মেয়েদের অপুষ্টি সমস্যা দূর করা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ এই অপুষ্টিই এঁদের বিভিন্ন রোগ ও প্রতিবন্ধকতার দিকে নিয়ে যায়।
- বালিকা ও নারীদের পুষ্টি পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যমূলক আচরণ যথার্থ পরিকল্পনার মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করা হবে।
- পুষ্টির ব্যাপারে পরিবারের অভ্যন্তরে যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে এবং অন্তঃসত্ত্বা ও সদ্য মা হওয়া মেয়েদের বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে পুষ্টি সম্পর্কিত শিক্ষার ব্যাপক ব্যবহার করা হবে। পরিকল্পনা এবং তার তত্ত্বাবধান ও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হবে।
পানীয় জল ও পরিচ্ছনতা
মহিলারা যাতে বাড়ির কাছাকাছি, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা ও শহরের বস্তিতে পরিশ্রুত পানীয় জল, যথার্থ নিকাশি ব্যবস্থা ও শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ পান তার ব্যবস্থা করা হবে। এ ধরনের পরিষেবার পরিকল্পনা, রূপায়ণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হবে।
আবাসন ও আশ্রয়
আবাসন নীতি, আবাসন কলোনির পরিকল্পনা ও গ্রাম-শহরে আশ্রয় তৈরির ব্যাপারে মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মহিলাদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। একক মহিলা, কর্মরতা মহিলা, ছাত্রী ও প্রশিক্ষণরতা মহিলারাও যাতে তার সুযোগ পান সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে।
পরিবেশ
পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের নীতি ও কর্মসূচিতে মহিলাদের যুক্ত করা হবে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হবে। নারীর জীবনে পরিবেশের প্রভাবের কথা মাথায় রেখে পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হবে। গ্রামে বসবাসকারী মহিলাদের একটা বড় অংশ আজও পশুর মল, ফসলের বর্জ্য ও জ্বালানি কাঠের মতো স্থানীয় ভাবে সংগ্রহযোগ্য অবাণিজ্যিক শক্তির উৎসের উপর নির্ভর করেন। এই ধরনের অপ্রচলিত শক্তির উৎসকে যাতে সঠিক ভাবে পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে কাজে লাগানো যায় তার জন্য অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহারের উপযুক্ত নীতি ও কার্যক্রম তৈরি করা হবে। নারীকে সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস, ধোঁয়াবিহীন চুল্লি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হবে যাতে এর প্রভাবে পরিবেশচক্র প্রভাবিত হয় এবং গ্রামীণ মহিলাদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে বদল আসে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিজ্ঞান ও কারিগরী ক্ষেত্রে মেয়েদের আরও বেশি করে অংশগ্রহণের উপযোগী কার্যক্রম নেওয়া হবে। এর জন্য মহিলারা যাতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি করে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার দিকে আকৃষ্ট হন তার ব্যবস্থা করা হবে এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বৈজ্ঞানিক আবহ তৈরি করতে ও সচেতনতা বাড়াতে জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ক্ষেত্রের মতো যেখানে তাঁদের বিশেষ দক্ষতা আছে, সেখানে তাঁদের যথার্থ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। মেয়েদের উপযোগী প্রযুক্তি উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে এবং তাঁদের একঘেয়ে পরিশ্রম যাতে কমানো যায় তারও ব্যবস্থা করা হবে।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নারী
নারীর বৈচিত্রময় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে যারা অসহায় তাঁদের কথা ভেবে ব্যবস্থা ও কার্যক্রম নেওয়া হবে যাতে তাঁরা যথার্থ সহযোগিতা পান। এ ধরনের মহিলারা হলেন, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মহিলা, নিরাশ্রয় মহিলা, অসুবিধায় পড়া মহিলা, প্রাকৃতিক কারণে বিপাকে পড়া মহিলা, কম উন্নত এলাকার মহিলা, অসহায় বিধবা, বয়স্ক মহিলা, দুর্ভোগে পড়া একক মহিলা, পরিবারের শীর্ষে থাকা মহিলা, কর্মচ্যুত মহিলা, উদ্বাস্তু, বিবাহজনিত হিংসার শিকার, পরিত্যক্তা, দেহপোজীবী মহিলা প্রমুখ।
সূত্রঃ Women S&T (Department of Biotechnology)