পশ্চিমবঙ্গের ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ অফিস বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির দেখভাল করে। এর মধ্যে রয়েছে ভবঘুরে ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক দিক দিয়ে লজ্জাজনক ব্যাপার প্রতিরোধ করা। এ ব্যাপারে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প যেমন ওএপি, ডাবলুপি এবং ডিপি (কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে) রয়েছে। এ ছাড়াও ছোটদের দ্বারা ভিক্ষাবৃত্তি করানো ও ছোটদের ভবঘুরে বৃত্তি (৮ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত) রোধের একটি প্রকল্পও রয়েছে। এ ছাড়াও সুসংহত শিশু নিরাপত্তা প্রকল্পের (আইসিপিএস) প্রকল্পের আওতাধীন মুক্ত আশ্রয় স্থল দেখভাল করার বিষয়টিও এই অফিস করে থাকে। আইসিপিএস প্রকল্পের টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের হলেও প্রকল্পটি দেখভাল করার সম্পূর্ণ দায়িত্বই রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের। এই আশ্রয়স্থলগুলি আপাতত কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলগুলিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সি বাচ্চারা এখানে থাকার সুযোগ পায়। এই আশ্রয়স্থলগুলি পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। এই অফিস আরও দু’টি প্রকল্প দেখভাল করে। সেগুলি হল, কর্মরত বাচ্চাদের কল্যাণার্থে যত্ন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকল্প এবং শিশু বেশ্যাবৃত্তি রোধে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রকল্প (৬ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত)।
এই অফিসের মুখ্য কাজ হল বেঙ্গল ভ্যাগ্রান্সি অ্যাক্ট ১৯৪৩ বা বাংলার ভবঘুরে নিবৃত্তি আইন ১৯৪৩-এর বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী কাজ করা। এই আইনের মূল কথা হল ভবঘুরেদের রাস্তায়-ঘাটে ফেলে রাখলে চলবে না। তাদের তুলে এনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় ও এক জন মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক হিসাবে জীবনযাপন করতে পারে। এই আইনের আওতায় আটক ভবঘুরেদের আশ্রয়, শিক্ষা ও জীবনযাপনের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলি মেটানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এ জন্য ১০টি হোম রয়েছে। খাদ্য, শয়নের উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং জামাকাপড়ের জন্য ভবঘুরে পিছু মাসে ১২৫০ টাকা করে এই হোমগুলিকে বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে তাদের ওষুধের ব্যবস্থা করা, পুনর্বাসনের প্রয়োজনে তাদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করাও রয়েছে।
ভবঘুরেদের জন্য রাজ্যে স্থাপিত হোমগুলিতে মোট ২৩৭৫ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে এখানে রয়েছেন ১৩০১ জন ব্যক্তি। হোমগুলিতে কত জনকে রাখা যেতে পারে তার পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। এই লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ দফতর কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। আদৌ বর্তমান ধারণক্ষমতায় আরও বেশি সংখ্যক ভবঘুরেকে স্থান দেওয়া যায় কিনা, কিংবা হোমগুলির ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধক প্রকল্প অনুযায়ী এদের স্বনির্ভর করার জন্য নানা পেশার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন মুদ্রণের কাজ, টেলারিং এবং বয়নশিল্পের কাজ, পটারির কাজ ইত্যাদি। নীচের টেবিল দেখাচ্ছে হোমগুলিতে ভবঘুরেদের সংখ্যা কত।
|
সংখ্যা |
ক্ষমতা |
||
হোমের ধরন |
পুরুষ |
মহিলা |
পুরুষ |
মহিলা |
রিসিভিং সেন্টার |
১ |
- |
১০০ |
- |
সক্ষমদের ভবঘুরে আবাস |
২ |
১ |
৫২৫ |
৪০০ |
প্রতিবন্ধীদের ভবঘুরে আবাস |
২ |
১ |
৩০০ |
১০০ |
সমস্ত বর্গের জন্য ভবঘুরে আবাস |
৩ |
- |
৯৫০ |
- |
মোট |
৮ |
২ |
১৮৭৫ |
৫০০ |
এই হোমগুলিতে সচরাচর প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে। যেখানে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল সেখানে ভবঘুরে প্রতিরোধ অফিস অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কথা বলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। একেবারে অক্ষম প্রতিবন্ধী ভবঘুরেদের জন্য নিয়মিত দেখভালের ব্যবস্থা করার কথাও আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে। সেইমতো সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তা সমাজকল্যাণ দফতর দেখভাল করে।
বেঙ্গল ভ্যাগ্রান্সি অ্যাক্ট ১৯৪৩ দ্বারা ১০টি নিম্নলিখিত আবাস পরিচালিত হয়
সংখ্যা |
তালিকা ও ঠিকানা |
১ |
রিসিভিং সেন্টার, ১৫৩ শরৎ গোষ গার্ডেন রোড, ঢাকুরিয়া, কলকাতা-৭৮, ফোন-০৩৩-২৪১৫-১৬৫৪ |
২ |
নিউ ভ্যাগ্রান্সি হোম, ১৫৩ শরৎ ঘোষ গার্ডেন রোড, ঢাকুরিয়া, কল-৭৮, ফোন ০৩৩-২৪১৫-১৬৫৪ |
৩ |
ক্যাজুয়াল ভ্যাগ্রান্ট হোম, ১২০ আন্দুল রোড, হাওড়া-৩, ফোন-০৩৩-২৬৬৮-২৪২৭ |
৪ |
লেপ্রসি ভ্যাগ্রান্টস হোম, ৭৫/১ বেলেঘাটা মেন রোড, কলকাতা-১০, ফোন-০৩৩-২৩৭০-৩৪৭৪ |
৫ |
ফিমেল ভ্যাগ্রান্ট হোম, ১০ রাজমোহন রোড, উত্তরপাড়া, হুগলি-৭১২২৫৮, ফোন-০৩৩-২৬৬৩-৪১৫৬ |
৬ |
মেল ভ্যাগ্রান্ট হোম, পেট্রাপোল, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা-৭৪৩৭০৪, ফোন-০৩২১৫-২৪৫১২২ |
৭ |
স্পেশাল ভ্যাগ্রান্টস হোম,ওল্ড জেল বিল্ডিং,মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর-৭২১১০১,ফোন-০৩২২২-২৭৫৭৭৯ |
৮ |
ট্রেনিং কাম প্রোডাকশন সেন্টার, তাঁতিগেরিয়া, জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর, পিন-৭২১১০১, ফোন-০৩২২২০২৭৫৮৩২ |
৯ |
হোম ফর লুনাটিক ভ্যাগ্রান্টস(মেল), মহালন্দি কলোনি, হাজারপুর, নবগ্রাম, জেলা-মুর্শিদাবাদ-৭৪২১৮১, ফোন-০৩৪৮৪-২৭৭১২১ |
১০ |
হোম ফর লুনাটিক ভ্যাগ্রান্টস(ফিমেল), মহালন্দি কলোনি, হাজারপুর, নবগ্রাম, জেলা-মুর্শিদাবাদ-৭৪২১৮১, ফোন-০৩৪৮৪-২৭৭১২১ |
আদালতের নাম |
জেলা |
এলাকা |
মিউনিসিপাল ম্যাজিস্ট্রেট সেকেন্ড কোর্ট কলকাতা |
কলকাতা |
কলকাতা পুরসভা অঞ্চল |
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থার্ড কোর্ট হাওড়া |
হাওড়া |
হাওড়া পুরসভা অঞ্চল |
এসডিজেএম ব্যারাকপুর উত্তর |
উত্তর ২৪ পরগনা |
ব্যারাকপুর সাব ডিভিশন |
২০১২-১৩ সালে সমাজকল্যাণ অধিকরণ মোট ৮০৮ জন ভবঘুরেকে আদালতে পেশ করেছে।
প্রতিষ্ঠানে যে সব ভবঘুরে থাকে তাদের নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি প্রদান করা হয় ---
অফিস অফ দ্য কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগ্রান্সি নিম্নলিখিত কর্মসূচিগুলিরও রূপায়ণ করে থাকে---
শিশুদের ভবঘুরেবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এদের পড়া, লেখা এবং অঙ্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা পরবর্তীকালে হাতের কাজ খুঁজে বা অন্য ভাবে জীবিকার সংস্থান করতে পারে। এদের ক্ষমতাবৃদ্ধির লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ দফতর ছ’টি ইউনিট খুলেছে। এগুলি হল-শিয়ালদা, রাজাবাজার, ঢাকুরিয়া, বেহালা, আন্দুল ও উত্তরপাড়ায়। এই কেন্দ্রগুলি শিশুদের ভবঘুরেবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃত্তি রোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় চলে। সমাজের ভঙ্গুর অংশের ৩০০ ছেলেমেয়েকে নিয়মিত মিড ডে মিল (মাথা পিছু খরচ ৫ টাকা), অপ্রথাগত শিক্ষা, বিভিন্ন বিষয়ে বৃত্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় (খেলনা তৈরি, টেলারিং, বই বাঁধাই, চামড়ার কাজ, ছুতোরের কাজ ইত্যাদি)
কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগ্রান্সির নিয়ন্ত্রণাধীনে ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধক প্রকল্প চলে। এই প্রকল্পের আওতায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন হোমে সক্ষম ভবঘুরে ভিখারিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এর মূল লক্ষ্য হল তাদের সুচারু ভাবে সমাজের মূল স্রোতে টেনে আআ এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো জঘন্য পেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। এই প্রকল্পের আওতায় টেলারিং, বুক বাইন্ডিং, পটারি, কারপেন্ট্রি, প্রিন্টিং, লেদার ওয়ার্কস প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।
এই অফিস থেকে বৃদ্ধাবস্থার পেনশন, বিধবা পেনশন এবং প্রতিবন্ধীদের পেনশন বণ্টনেরও ব্যবস্থা করা হয়। এর পরিমাণ মাসে ৭৫০টাকা। কলকাতা এবং সন্নিহিত উত্তর ২৪ পরগনার ছ’টি পৌরসভা এলাকায় পেনশন বণ্টনের দায়িত্ব এই অফিসের। কলকাতা সন্নিহিত যে ছ’টি পৌর এলাকায় পেনশন বণ্টন করা হয় সেগুলি হল, দমদম, দক্ষিণ দমদম, উত্তর দমদম, বরানগর, কামারহাটি ও বিধাননগর।
২০১২-১৩-তে কোন বর্গের ক’জন পেনশন পেয়েছেন তা নিম্নে দেওয়া হল ---
ওল্ড এজ পেনশন বা বৃদ্ধাবস্থাকালীন পেনশন |
উপভোক্তার সংখ্যা ৯১০৮ |
---|---|
বয়স্ক বিধবা পেনশন |
উপভোক্তা ৯১৪৪ |
প্রতিবন্ধকতা পেনশন |
উপভোক্তা ৫৩৪৭ |
২০০৯-১০ সালে সুসংহত শিশু নিরাপত্তা প্রকল্প চালু হওয়ায় রাস্তার শিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারটি এই প্রকল্পের আওতায় চলে আসে এবং মুক্ত আশ্রয় শিবির বা হোমগুলি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই কারণে আইপিএসসি নামে যে পুরনো প্রকল্পটি ছিল সেটি ৩১ মার্চ ২০১১-তে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং আইসিপিএসের আওতায় থাকা মুক্ত আশ্রয় শিবিরগুলি ২০১১ সালের গোড়া থেকেই ২৪ ঘণ্টার বিপদ ব্যবস্থাপন কেন্দ্র বা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার হিসাবে কাজ করতে থাকে। এই কেন্দ্রগুলির কাজ হল প্রয়োজন আছে এমন সব ধরনের শিশুদের, বিশেষ করে ফুটপাথের বাসিন্দা, কাগজ কুড়ানি, রাস্তার ভিখারি, পরিত্যক্ত, অনাথ, পাচার হয়ে আসা, ড্রাগে আসক্ত শিশুদের যত্ন, নিরাপত্তাজনিত সহায়তার ব্যবস্থা করা। ধনী-দরিদ্র, জাত, ধর্ম নির্বিশেষে সব ধরনের শিশুদের এই সাহায্য দেওয়া হয়ে থাকে।
এই ধরনের আশ্রয় শিবিরে যে সব পরিষেবা দেওয়া হয় তা হল, চার বেলা পেটভরা খাবার, নিয়মিত বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া, বৃত্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ওষুধপত্রের ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া (অর্থাৎ নেশামুক্তির ব্যবস্থা করা), বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ৬ থেকে ১৮ বছরের শিশু ও কিশোররা এই আশ্রয় শিবিরগুলিতে থাকার সুযোগ পেয়ে থাকে। বর্তমানে ১৮টি এই ধরনের মুক্ত আশ্রয় শিবির চলছে। তার মধ্যে ১২টি চলছে কলকাতায় এবং ৪টি উত্তর ২৪ পরগনায় ও ২টি হাওড়া জেলায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন দফতর ২০০৪-০৫ সালে এই প্রকল্পটি প্রণয়ন করেছে যার লক্ষ্য হল কর্মরত শিশুদের সমাজের মূল স্তরে নিয়ে আসা/আবার নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। বর্তমানে তিনটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ৬ থেকে ১৮ বছর বয়সি ৩৫০টি বাচ্চা নিয়ে এই প্রকল্প রূপায়ণ করছে। এর সব ক’টিই দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও কার্শিয়াঙে অবস্থিত। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্য সংস্থান, আশ্রয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কাজ করছে। পাশাপাশি অপ্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কাজেও সাহায্য করছে।
মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী রাজ্য সরকার অত্যন্ত সফল ভাবে শহুরে গৃহহীনদের জন্য তিনটি মিউনিপ্যাল কর্পোরেশন এলাকায় অর্থাৎ কলকাতা, হাওড়া ও আসানসোল পুর এলাকায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। শহুরে গৃহহীনরা যাতে এই সব আশ্রয়ে ঠাঁই পেয়ে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারেন সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাঁদের বিছানা, কম্বল, মাদুর দেওয়া হয়েছে। বাথরুম ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন এই সব অসহায় মানুষজন। তাদের বহনযোগ্য জলও দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের আওতায় ৫ লক্ষের বেশি বাসিন্দা রয়েছেন এমন সব শহরে প্রতি এক লক্ষ নাগরিক পিছু একটি করে এই ধরনের আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা।
রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই এই তিন শহরে সরকারি অফিসে এ ধরনের ৬টি আশ্রয়স্থল, বেসরকারি জায়গায় ৩১টি আশ্রয়স্থল গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং এগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে।
সরকারি জায়গায় আশ্রয়স্থলের অনুমোদন |
৬টি |
---|---|
কলকাতা পুরসভা এলাকায় মহিলাদের জন্য আশ্রয়স্থল |
২টি |
কলকাতা পুরসভা এলাকায় মহিলা ও পুরুষ উভয়ের জন্য আশ্রয়স্থল |
১টি |
হাওড়া পুর এলাকায় শুধু পুরষদের জন্য আশ্রয়স্থল |
১টি |
হাওড়া পুর এলাকায় শুধু মহিলা উভয়ের জন্য আশ্রয়স্থল |
১টি |
আসানসোল এলাকায় পুরুষদের জন্য আশ্রয়স্থল |
১টি |
বেসরকারি জায়গায় আশ্রয়স্থলের অনুমোদন |
৩১টি |
কলকাতা পুর এলাকায় |
২৪টি |
কলকাতা পুর এলাকায় পুরুষদের জন্য |
১৬টি |
কলকাতা পুর এলাকায় মহিলাদের জন্য |
৭টি |
কলকাতা পুর এলাকায় পুরষ ও মহিলাদের জন্য |
১টি |
হাওড়া পুর এলাকায় |
৫টি |
পুরুষদের জন্য |
৪টি |
মহিলাদের জন্য |
১টি |
আসানসোল পুর এলাকায় |
২টি |
পুরুষদের জন্য |
২টি |
ইতিমধ্যেই হাওড়ায় দু’টি ও আসানসোলে আরও একটি আশ্রয়স্থল গড়ার অনুমোদন মিলেছে। হাওড়া ও আসানসোলে এ ধরনের আশ্রয়স্থল গড়তে চেয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি আরও ১৪টি প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগ্রেন্সি, পশ্চিমবঙ্গ -- এই আইনের ৭(২) ধারার আওতায় সংশ্লিষ্ট ট্রাইবুনালটির দেখভাল করে থাকে। ম্যানেজার, হেডকোয়াটার্স, কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগ্রেন্সি কলকাতার ২৪টি থানা এলাকায় আইনের ১৮(১) ধারা মোতাবেক মেইনটেনেন্স অফিসারের কাজ করে। সম্প্রতি সামাজিক কারণে বৃদ্ধ-বাবা মাকে দেখাশোনা করার বিষয়টি ক্রমশ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে পরিবারের মধ্যে বৃদ্ধ বাবা-মা বা অন্য বৃদ্ধ সদস্য থাকলে তাদের উপেক্ষা করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করছে। অনেক সময় সন্তান-সন্ততির প্রতি ভালোবাসার হেতু এই সব বৃদ্ধা-বৃদ্ধা চুপ করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে অনেক সময় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে তাঁদের আশ্রয়স্থল থেকে বিতাড়িত করা হয়। অনেক সময় তাঁদের শারীরিক নিগ্রহেরও শিকার হতে হয়। আগে যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব থাকায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা স্বচ্ছন্দে এবং মনের আনন্দে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যৌথ পরিবারের ধারণা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। শহুরে মধ্যবিত্তরা চাইছেন শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সংসার অতিবাহিত করতে। বাবা-মার স্থান হচ্ছে হয় নিতান্ত একাকিত্বের গহ্বরে নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে। যাঁদের অর্থ রয়েছে, তাঁরা হয়তো অর্থের বিনিময়ে বৃদ্ধাশ্রমের সুযোগ পাচ্ছেন, কিন্তু অনেকেই সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই অসহায় অবস্থার চিত্র বহু সময় হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে দেখতে পাই। কখনও মাননীয় বিচারপতির কাছে গিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা সুবিচার চাইছেন। কখনও নিতান্ত খোরপোষের জন্য আবেদন করছেন। সংবাদপত্রে এই সব বিবরণ পড়তে পড়তে চোখের জল সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। অসহায় এই সব মানুষজন হয়তো এক সময় সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের অমোঘ টানে তাঁদের ছিটকে এক কোণে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই অসহায় মানুষদের অবস্থার কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার আইন করার চেষ্টা করেছে। কলকাতায় কলকাতা পুলিশ ‘প্রণাম’ কার্যক্রমের মধ্যে দিয়েও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শুধু আইন করে এই সমস্যার সমাধান করা যায় না। ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে না পারলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা চোখের জলে কালাতিপাত করতে বাধ্য হবেন।
ভবঘুরে মানুষদের সঙ্গে সরকারি আধিকারিকরা বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা নিয়মিত কথা বলেন। তাঁদের পরিবারের কথা জানতে চান। কখনও তাঁরা নিজেদের পরিবারের কথা স্মরণ করতে পারেন, কখনও পারেন না। কেন তাঁরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন, তাঁদের মানসিক বা অন্য কোনও ধরনের সমস্যা হয়েছিল কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। দেখা যায় কখনও তাঁরা পরিবারের কাছে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন, কখনও বা নিস্পৃহ অবস্থান নিচ্ছেন। অনেকে আবার কাল্পনিক পরিবারের কথা বলেন। কাল্পনিক স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কথা জানান। এঁদের কাছে পরিবার কেবলমাত্র স্বপ্নেই বিরাজ করে। বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। অনেক সময় তাঁদের পরিবারকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলেও তাঁরা অসহায় মানুষটিকে ফিরিয়ে নিতে একদমই আগ্রহ প্রকাশ করেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁকে স্থায়ীভাবে কোনও আশ্রয়স্থলে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়।
কলকাতার ফার্স্ট ক্লাস জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, থার্ড কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে চাঁদমোহনবাবুকে হোমে ভর্তি করা হয়েছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তে তাঁর বড়দা রাইমোহন মণ্ডল খোঁজ পেয়ে ভাইকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। চাঁদমোহনবাবুর বাড়ি নদিয়ার চাকদহে।
রিচার্ড মাথুর ওরফে রিচার্ড মার্টিন ঢাকুরিয়ার ওসিআরসি হোমে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি ভর্তি হয়েছিলেন। বৃদ্ধ মানুষটি মৃগী রোগে ভুগছিলেন। গোড়ায় তিনি তাঁর বাড়ির ঠিকানা ঠিকঠাক বলতে পারেননি। মেডিক্যাল অফিসার তাঁর চিকিৎসা করতে শুরু করেন। তিনি চিকিৎসায় বেশ ভালোই সাড়া দেন এবং তাঁর রোগও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। কিছুদিন বাদে তিনি বলেন, তিনি একজন খ্রিস্টান এবং অ্যাসেম্বলি অফ গডচার্চের কর্মী (ঠিকানা, ১৮ নম্বর রয়েড স্ট্রিট কলকাতা-১৬)। ২৮ জুন ২০১৩-তে তাঁকে হোম থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তিনি চার্চে ফিরে যান। অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ পরবর্তীকালে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়। এখন তিনি অত্যন্ত সুখে চার্চেই কাজে নিয়োজিত আছেন। তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব হোমের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ সরকার এবং শিক্ষক স্বপন চক্রবর্তীর। তাঁরা ধৈর্যের সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বের করতে পেরেছিলেন।
প্রয়াত প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র কেষ্ট মুখোপাধ্যায় আমতার একটি চায়ের দোকানে কাজ করতেন। তিনি ১২ মার্চ ২০১২-তে হোমে আসেন। খবর পেয়ে তাঁর ভাই হাওড়ার আমতার ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা তপন মাইতি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
সূত্র : অফিস অফ দ্য কন্ট্রোলার অফ ভ্যাগ্রান্সি, অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০১২-১৩, নারী, শিশু উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণ দফতর,পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/15/2020