গ্রামের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। কেউ নিজের জমিতে চাষ করেন, আবার নিজের জমি না থাকার জন্য কেউ অন্যের জমিতে দিন মজুর হিসাবে কাজ করেন। কিছুমানুষ মাছ চাষ করেন। কেউ কেউ বাড়িতে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু ইত্যাদি পালন করেন। কেউ কেউ আবার ঝুড়ি বোনা, চাটাই বোনা, দড়ি বোনা, মাটির জিনিস তৈরি করা, ইত্যাদি ননান ধরনের ছোট ছোট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ধোপা, নাপিত, জেলে, এরকম যারা রয়েছেন তারা নানান পরিষেবা দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার দিন মজুর হিসাবে কাজ করার জন্য এলাকার বাইরেও চলে যান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কেবল মাত্র চাষবাসই নয়, গ্রামের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষেরা নানান উপায়ে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেন।
গ্রামের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষেরা সাধারণত চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরিবারের আয় বাড়ানোর পথ হিসাবে প্রাণীপালন এখন কৃষির পরের স্থানেই রয়েছে। প্রাণীসম্পদ কথাটির মধ্যেই বোঝা যায় যে অন্যান্য সম্পদের মতোই প্রাণীও মানুষের কাছে একটি সম্পদ। গৃহপালিত প্রাণী সম্পদের মান বাড়ানো হলে পরিবারের আয়ও বাড়বে। গ্রামের গরিব মানুষেরা বহুকাল আগে থেকেই প্রথাগতভাবে প্রাণীপালন করে আসছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণীগুলির মান ভাল নয় বলে দুধ, ডিম, মাংস ইত্যাদি কম পাওয়া যাচ্ছে। দেশী প্রজাতির প্রাণীদের বিজ্ঞান সম্মত প্রথায় লালন পালন করে দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানো যায়। যদি উন্নতমানের প্রজাতির সঙ্গে দেশী তির প্রাণীর সংকরায়ন করা যায়, তবে সেই উন্নত প্রাণীদের থেকে আমরা অনেক বেশি পরিমানে দুধ, মাংস, ডিম ইত্যাদি পেতে পারি। সাধারণভাবে এটাই হল প্রাণীসম্পদের উন্নয়ন। প্রাণীসম্পদের উন্নয়ন হলে আয়ও বাড়বে, মানুষের জীবিকার মানও বাড়বে।
আদিকাল থেকে মানুষ প্রাণীপালন করে এলেও বর্তমানে গ্রামের সব পরিবার প্রাণীপালনের সঙ্গে যুক্ত নয়।দেখা যাচ্ছে, যে সব পরিবার প্রাণীপালন করে, তাদের পরিবারের সবাই এই কাজে যুক্ত নয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক পরিবার একাধিক প্রাণী পালন করে না। কারোর হয়তো দুটো হাস আছে – একই সঙ্গে আরো দুটো হাস, কয়েকটা মুরগি, একটা ধাড়ি ছাগল পোষা যেতেই পারে। এতে ডিম আর দুধের যোগান নিশ্চিত হবে, ফলে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মিটবে এবং শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী মা ও বোনেদের অপুষ্টি দূর হবে। আবার বাড়তি কয়েকটা ডিম পাওয়া গেলে তা বাজারে বিক্রি করে কিছু পয়সা ঘরে আনা যায়। এছাড়া খাদ্যবস্তু হিসাবে ডিম ও মাংসের চাহিদা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে প্রাণী পালনের ব্যবসা করলে, এই দিয়ে বাড়ির বেকার ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থানও হতে পারে। কৃষিকাজে খরচ বেড়েছে কিন্তু ফসলের দাম সেই হারে বাড়েনি। ফলে কৃষকের আয় আনুপাতিক হারে কমেছে। তাই গ্রামের পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলির মধ্যে যারা জীবিকার জন্য প্রধানত চাষবাসের উপর নির্ভরশীল তারা প্রাণী পালনের মাধ্যমে পরিবারের আয় বাড়াতে পারেন অথবা এটিকে বিকল্প জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন।
পশ্চিমবঙ্গে যে পরিমাণে দুধ, মাংস, ডিম উৎপাদন হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই চাহিদা মেটাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা অন্য রাজ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই এ রাজ্যে প্রাণী সম্পদের বিকাশের অনেক বেশি প্রয়োজন আছে এবং যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রাণী সম্পদ বিকাশের জন্য প্রয়োজন মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করা। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির লক্ষ্য হবে — সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধার খবর গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং যুব-সংগঠন ও মহিলাদের স্বনির্ভর দলগুলিকে এই কাজে যুক্ত করা। প্রাণী পালনের মাধ্যমে গ্রাম সংসদ এলাকার স্বনির্ভর দলগুলিকে এই কাজে যুক্ত করা। প্রাণী পালনের মাধ্যমে গ্রাম সংসদ এলাকার বেকার যুবক-যুবতীদের স্বনির্ভর করার জন্যও গ্রাম উন্নয়ন সমিতি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। গ্রাম উন্নয়ন সমিতি প্রাণীসম্পদ বিকাশের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নিতে পারে তার কয়েকটি নমুনা হল -
প্রাণী সম্পদ বিকাশ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে হাঁস, মুরগি, ছাগল, গাভী ইত্যাদি পালন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ, দরিদ্র পরিবারের মধ্যে হাস ও মুরগির বাচ্চ বিতরণ, - পশুখাদ্য চাষের জন্য বীজ বিতরণ, সংকর জাতের ছাগল - ও ভেড়া বিতরণ, খরগোশ পালন কেন্দ্র স্থাপন, শূকর " - খামার তৈরি ও পালনে সহায়তা ইত্যাদি। এছাড়াও প্রাণী খাদ্য তৈরির জন্য সুষম খাদ্য উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি ও গোখাদ্য চাষের জন্য অনুদান ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি " ত্র রয়েছে। ব্লকের প্রাণী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজনন পরিষেবা, - গবাদিপশুর টিকাকরণ,কৃমি-নাশক ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি সুবিধা পাওয়া যায়। ব্লকের প্রাণী স্বাস্থ্য আধিকারিকের পরিচালনায় গ্রামাঞ্চলে প্রাণী স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করা হয়। বর্তমানে প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের উদ্যোগে “পশ্চিমবঙ্গ মহিলা দোহ প্রকল্প” নামে একটি বিশেষ কর্মসূচি রূপায়িত হয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য দরিদ্র নারীদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করে তাদের উন্নয়ন ঘটানো। ১৮ বা তার বেশি বয়সের যে সমস্ত দরিদ্র পরিবারের নারী গবাদি পশু ও হাস মুরগি পালনের সঙ্গে যুক্ত, তারাই এই সমবায়ের সদস্য হতে পারবেন। যাদের গাভী নেই, তাদেরকে এস.জি.এস.ওয়াই, এস.সি.পি.টি.এস.পি., ঋণ ও অনুদানের সাহায্যে দুগ্ধবতী গাভী ও সংকর প্রজাতির বকনা বাছুর দেওয়া যেতে পারে। দোহ সমবায় সমিতি গড়তে হলে পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লক প্রাণী স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং জেলার প্রাণী সম্পদ বিকাশ কার্যালয়ে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
এটি হল একটি এলাকায় শিবির করে সকল প্রাণীর স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং এ বিষয়ে এলাকার মানুষদের - চেতনার মান বাড়ানো। এর জন্য কয়েকটি ছোট গ্রাম বা প্ৰ একটি বড় গ্রামের গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি একটি বড় মাঠে নির্দিষ্ট দিনে হাজির করানো হয়। তার পর সমস্ত প্রাণীকে টিকা দেওয়া, রোগের চিকিৎসা করা আর কৃমিনাশক ঔষধ দেওয়া হয়। এছাড়া গোখাদ্য, ঘাস চাষ ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রাণী পালনের বিষয়ে সকলকে জানানো হয়। প্রাণী স্বাস্থ্য শিবিরে সচেতনতা বিকাশের জন্য (ক) রোগ প্রতিরোধ, (খ) প্রাণী খাদ্য ও ঘাষ চাষ, (গ) বাসস্থান, জলের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিচ্ছন্নতা, এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়। কোনো কোনো এলাকায় প্রাণী স্বাস্থ্য শিবির বছরে দুই বার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
প্রাণী স্বাস্থ্য শিবিরে সাধারণত উপস্থিত থাকেন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যবৃন্দ, স্বনির্ভর দলের সদস্যরা, প্রাণী-পালকরা এবং প্রাণী সম্পদ দপ্তরের আধিকারিকরা।
যুবতীকে নির্বাচিত করে রাজ্যের প্রশিক্ষণ তাদের প্রাণী পালনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এদেরই বলা হচ্ছে প্রাণীবন্ধু। প্রশিক্ষণ শেষে
এদের প্রথম কাজ হল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি পরিবারের গবাদি পশু ও হাঁস মুরগি ইত্যাদির পরিসংখ্যান নেওয়া। প্রাণীবন্ধুকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপকরণ যেমন তরল নাইট্রোজেন, হিমায়িত গোবীজ, ষ্ট্র ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম প্রজনন ছাড়াও প্রাণীবন্ধু গবাদি পশুর প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিষেধক টিকা দেবার কাজ করেন। এর জন্য তিনি সরকারের ঠিক করে দেওয়া পারিশ্রমিক নেন। গ্রামের উদ্যোগী মহিলারা অল্প আয়াসেই প্রাণীবন্ধু হিসাবে নিযুক্ত হতে পারেন।
গরু / মহিষ তড়কা, বাদলা (বজবজা), গলাফুলা, এসো (খুড়াই বা খুরুয়া) ছাগল / ভেড়া বসন্ত, পি. পি. আর.হাঁস, মুরগি ডাকপ্লেগ, রাণীক্ষেত, ডাক্কলেরা, ককসিডিয়া ইত্যাদি
প্রাণীদের সংক্রামক রোগের প্রতিরোধের জন্য যে ইনজেকশন দেওয়া হয়, তাকে টিকাকরণ বলে।গবাদি পশু ও প্রাণীদের রোগ হলে অবশ্যই উপযুক্ত চিকিৎসার দরকার। কিন্তু এমন কিছু রোগ আছে যেগুলি হলে, আক্রান্ত প্রাণীটিকে বাচানো অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মনে রাখতে হবে, ‘রোগের চিকিৎসা করার থেকে রোগ প্রতিরোধ ভালে উপায়’। আর সুস্থ প্রাণীকে সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দিলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। তবে বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকাকরণের জন্য প্রাণীবন্ধু ও ভি.এস. — এদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
সু্ত্র: পঞ্চায়েত এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/18/2019