আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কলা একটি অন্যতম প্রধান ফল। সারা দেশে আনুমানিক ১,৬৪,০০০ হেক্টর জমিতে এই ফলটির চাষ হয়। মূলত পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, আসাম ও ওড়িশা রাজ্যের মধ্যে কলা চাষ সীমাবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গে ফল চাষের মধ্যে এলাকার নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে এবং উৎপাদনের নিরিখে প্রথম স্থানে আছে কলা। আনুমানিক ২৫,০০০ হাজার হেক্টর জমিতে এই ফলটির চাষ হয় এবং আনুমানিক ৫,০০,০০০ লক্ষ টন ফল উত্পাদিত হয়। যদিও অন্যান্য আজ্যের তুলনায় হেক্টর প্রতি চারার সংখ্যা ও উত্পাদনশীলতা ২ – ৩ গুণ কম এবং গতানুগতিক পদ্ধতিতে চাষ করার ফলে ফলনের পরিমাণ ও গুণগত মানও বেশ খারাপ। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর চাষ করলে আমাদের রাজ্যেও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে, এই উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে টিসু কালচার পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে চারা তৈরি করা হচ্ছে। এই চারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল —
যে হেতু এই ফলটি স্যাঁতস্যাঁতে আর্দ্র ও গরম আবহাওয়া পছন্দ করে সে কারণে পৃথিবীর মধ্যে ট্রপিক্যাল (ক্রান্তীয়) এলাকাভুক্ত অঞ্চলের মধ্যেই এই ফলটির চাষ সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন পূজা পাঠ ও শুভ অনুষ্ঠানে এই ফলটির ব্যবহার চলছে। রীতিমতো সমাদৃত এই ফল। যে কারণে দেশের মধ্য এই ফলটির চাহিদা সারা বছর ধরে থাকে। শুধু ফলই নয় কলা গাছ ও বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানে কলা গাছের খুব প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন পূজাপার্বণ হোক বা বিবাহ অনুষ্ঠানই কিংবা গৃহে প্রবেশ অনুষ্ঠান অথবা নুতন বছরের ব্যবসা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান --- সব ক্ষেত্রেই এই গাছটির প্রয়োজন রয়েছে। আর দুর্গাপূজায় গণেশের পাশে কলাবউকে কি ভলা যায়? এরই সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কলাপাতার ব্যবহারের রীতি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। যে কারণে কলার চাষ প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে হয়ে আসছে।
বর্তমানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে কলার প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কলার পাউডার তৈরি তা খাওয়ার অভ্যাস আমাদের দেশেও প্রচলিত হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে এই ফলটির সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মর্তমান, চাঁপা, জায়েন্ট গভর্নর, রোবাস্টা, কাঁঠালি, কাঁচা কলা ইত্যাদি। এ ছাড়াও বর্তমানে টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে উত্পন্ন চারাও বহুল ব্যবহৃত।
সেচ ব্যবস্থা যুক্ত যে কোনও ধরনের মাটিতে এই ফলটির চাষ করা যায়। তবে আদর্শ মাটি হিসাবে জৈব পদার্থ যুক্ত বেলে- দোঁয়াশ মাটি কলা চাষের উপযোগী। এবং অবশ্যই জমিতে উপযুক্ত জল নিকাশি ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন আছে।
চারা বসানোর আগে জমি ভালো ভাবে চাষ দিয়ে রোদ খাইয়ে নিতে হবে। চারা লাগানোর ১০ – ১৫ দিন আগে ১ ফুট x ১ ফুট x ১ ফুট করে গর্ত করতে হবে। একটি গর্ত থেকে আর একটির দূরত্ব হবে ৬ ফুট x ৬ ফুট। এর পর প্রতি গর্তে ১০ – ১৫ কেজি গোবর সার, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০ গ্রাম সি সুপার ফসফেট ও ৭৫ গ্রাম মিউরেট অফ পটাশ ও তার সাথে উইপোকা দমনের জন্য ফিউরাডাল দানা উপরের স্তরের মাটির সঙ্গে ভালো ভাবে মিশিয়ে ভর্তি করতে হবে। চারা বসানোর ১ মাস পর থেকে, প্রতি দেড় মাস অন্তর মোট ৭ বার প্রতি গাছে জৈবসার বাদে উপরোক্ত একই পরিমাণ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা বসানোর আড়াই মাস পরে ১০ কেজি জৈবসার আর এক বার প্রয়োগ করতে হবে।
২ – ৩ মাস বয়সে, ১.৫ – ২ কেজি ওজনের, ৯০ সেন্টিমিটার — ১ মিটার উচ্চতায় নীরোগ সরু পাতা যুক্ত তেউড় হল রোপনের জন্য উপযুক্ত চারা। এ ছাড়া তেউড়ের পরিবর্তে ২ – ৩ মাস বয়সের ২ – ২.৫ ফুট উচ্চতায় টিস্যু কালচার করা চারাও লাগানোর উপযুক্ত। তেউড় লাগানোর সময় গোড়ার দিকের মরা পাতাগুলি ছেঁটে পরিষ্কার করে গর্তের মাঝখানে বসিয়ে চার দিক থেকে মাটি দিয়ে ভালো ভাবে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।
শীত কাল ছাড়া বত্সরের যে কোনও সময়ে চারা লাগানো যেতে পারে। তবে উপযুক্ত সময় হল আষাঢ় – শ্রাবণ ও আশ্বিন- কার্তিক মাসে।
ভালো ফলনের জন্য গাছের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি মাসে প্রতি গাছে ৫০ – ৭৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম সি সুপার ফসফেট ও ৭৫ – ১০০ গ্রাম ইউরেট অফ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়াও অনুখাদ্য হিসাবে জিঙ্ক ০.৫% ও বোরন ০.৩ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে ৩, ৫, ও ৭ মাস বয়স কালে প্রয়োগ করলে ফলন বৃদ্ধি পাবে।
ভালো ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সেচ দিতে হবে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে প্রয়োজনমাফিক সেচ দিতে হবে।
অতিরিক্ত তেউড় মূল গাছকে দুর্বল করে দেয়। সে জন্য ফুল আসার আগে মূল তেউড় রেখে দিয়ে অতিরিক্ত তেউড় তুলে ফেলে নষ্ট করে দিতে হবে। চারা কেটে ৩ – ৪ চামচ কেরোসিন তেল ঢেলে সহজেই অতিরিক্ত তেউড় নষ্ট করে দেওয়া যায়। প্রতি গাছে ফুল আসার পর প্রতিটি গর্তে একটি মাত্র সুস্থ ও সবল তেউড় রাখা বাঞ্ছনীয়।
কাঁদি আসার আগে, বাঁশের ঠেক দিয়ে গাছকে অবলম্বন দিতে হবে যাতে ঝড়ে বা কাঁদির ভারে গাছ পড়ে না যায়। এর পর কাঁদি সম্পূর্ণ আসার পরে মোচা কেটে নিতে হবে। এর ফলে ফলের ওজন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও গ্রীষ্মকালে নীল পলিথিন ও শীতকালে সাদা পলিথিন (৩৫ – ৪০ মিলি মাইক্রন) ব্যাগ দিয়ে কাঁদি ঢেকে দিলে পোকামাকড় ও সূর্যের তাপ থেকে ফলকে রক্ষা করা যায় আর ফলও তাড়াতাড়ি পাকে।
বর্ষাকালে, অতিরিক্ত বর্ষার ফলে গাছের গোড়ার মাটি সরে যায়। যে কারণে ভেলির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়াও গ্রীষ্মকালে ও শীতকালে সেচের সুবিধার জন্য সেচ নালির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অতিরিক্ত আয়ের জন্য কলা বাগানে প্রথম দিকে সাথি ফসল হিসাবে বিন, রসুন, মটরশুঁটি, পালং, মুলো, বাঁধাকপি, আদা ইত্যাদি ফসলের চাষ করা যেতে পারে।
ফুল আসার পর জাতি অনুযায়ী ৯০ – ১২০ দিনের মধ্য কাঁদি কাটার উপযুক্ত হয়ে যায়। লম্বা জাতের কলা বছরে ১১.০ – ১৫.০ টন প্রতি হেক্টরে ও বেঁটে জাতের কলা ১৫.০ – ১৮.৫ টন প্রতি হেক্টরে ফলন হয়।
ঠান্ডা জায়গায় কাঁদি পাকতে মোটামুটি ৬০০ – ৬৮০ ফারেনহাইট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। তা সে রৌদ্রের মধ্যে রেখেই হোক বা এক জায়গায় ডাই করে পলিথিন চাপা দিয়ে রেখেই হোক, মোটামুটি ৩০ – ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাঁদি পেকে যায়। এর পর কাঁদির মাথার দিকে কাটা জায়গায় কাদা অথবা আলকাতরা অথবা ভেসলিন লাগিয়ে রাখলে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণে পচনের হাত থেকে মুক্ত থাকা যায়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/27/2020