পাতা ঝলসানো (Leaf blight) রোগ
রোগের কারণ
অলটারনেরিয়া ব্রাসিসী (Alternaria brassicae) ও অলটারনেরিয়া ব্রাসিসিকোলা (Alternaria brassicicola) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
আক্রান্ত বীজ, বিকল্প পোষক ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়া এ রোগ বৃদ্ধির সহায়ক। ছত্রাকের বীজ কণা বাতাসের সাহায্যে সুস্থ গাছে ছড়ায়। আক্রান্ত পাতার উপর ছত্রাকের বীজ কণা সৃষ্টি হয় এবং পরে বাতাসের মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ
- সরিষা গাছের একমাস বয়স থেকে শুরু করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছে এ রোগ আক্রমণ করতে পারে।
- প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণ সরিষা গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় পরিলক্ষিত হয়।
- পরবর্তীতে এ ছত্রাকের আক্রমণে গাছের পাতা, কান্ড এবং ফল-এ চক্রাকার গাঢ় বাদামী বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়।
- ছোট ছোট দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে।
- দাগগুলো ধুসর, গোলাকার সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ থাকে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়।
- ফল ও বীজ হতে খাদ্য গ্রহন করায় ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
|
|
|
|
চিত্র: সরিষার পাতা ঝলসানো রোগের লক্ষণ |
রোগের প্রতিকার
- ফসল সংগ্রহের পর আক্রান্ত গাছের পাতা পুড়ে ফেলতে হবে।
- সুস্থ, সবল ও জীবানুমুক্ত বীজ বপন করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (যেমন-অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (যেমন-প্রোভ্যা* ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
- জমিতে শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে, যেমন-বারি সরিষা ১১ ও বারি সরিষা ১৬।
- আগাম বীজ বপন অর্থাৎ অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ থেকে নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখের মধ্যে বীজ বপন করলে এ রোগ কম হয়।
- পাতায় দাগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ইপ্রোডিয়ন (যেমন-রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা ডাইফেনোকোনাজল + এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন (যেমন-এমিস্টার টপ ৩২৫ এসসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
সপুষ্পক পরজীবি উদ্ভিদ (Parasitic plant) রোগ
রোগের কারণ
অরোব্যাঙ্কি প্রজাতি (Orobanche sp.) নামক সপুষ্পক পরজীবি উদ্ভিদ দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
অরোব্যাঙ্কি প্রজাতির বীজ মাটিতেই অবস্থান করে। ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে রোগের বিস্তার লাভ করে। প্রতি বছর একই জমিতে সরিষা পরিবারের ফসলের চাষ করলে এ পরজীবী উদ্ভিদের বিস্তার ঘটে।
রোগের লক্ষণ
- এ উদ্ভিদ এক প্রকার সপুষ্পক শিকড় পরজীবি যার বংশ বৃদ্ধি সরিষার উপর নির্ভরশীল।
- অরোব্যাঙ্কি প্রজাতির বীজ সরিষার মূলের সংস্পর্শে আসলেই গজাতে শুরু করে।
- সরিষা গাছের শিকড়ের সহিত এ পরজীবি উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপন করে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে।
- ফলে আক্রান্ত সরিষার গাছ দূর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়।
|
|
|
চিত্র: সরিষার সপুষ্পক পরজীবি উদ্ভিদ রোগের লক্ষণ |
রোগের প্রতিকার
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে, যেমন-বারি সরিষা ১১।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- ফুল আসার পূর্বেই এ পরজীবি উদ্ভিদ জমি হতে উঠিয়ে ধ্বংশ করে ফেলতে হবে।
- টিএসপি সার হেক্টর প্রতি ২৫০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
- বীজ বপনের পুর্বে গভীরভাবে জমি চাষ করতে হবে। এতে পরজীবির বীজ গভীরে চলে যাবে এবং সরিষার শিকড়ের স্স্পংর্শে আসতে পারবে না।
- আগাছা নাশক ২, ৪ ডি (ডাইক্লোরোফেনোক্সিএসিটিক এসিড- C8H6Cl2O3) ছিটিয়ে পরজীবি উদ্ভিদকে মেরে ফেলতে হবে।
ডাউনি মিলডিউ (Downy mildew) রোগ
রোগের কারণ
পেরোনোসপোরা ব্রাসিসি (Peronospora brassicae) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
আক্রান্ত বীজ ও বিকল্প পোষকের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এ ছত্রাকের জীবানু মাটিতে ১-২ বছর বেঁচে থাকতে পারে। গাছ ঘন থাকলে ও বাতাসের আর্দ্রতা কম হলে এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। দ্রুত রোগ বিস্তারের জন্য অনুকুল তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রি সেঃ।
রোগের লক্ষণ
- গাছের চারা অবস্থার পর থেকে যে কোন সময় এ রোগে গাছ আক্রান্ত হতে পারে।
- আক্রান্ত পাতার নিম্ন পৃষ্ঠে সাদা পাউডারের মত ছত্রাক স্পোর দেখা যায় এবং পাতার উপরের পৃষ্ঠ হলদে হয়ে যায়।
- অনুকূল আবহাওয়ায় এ ছত্রাকের দ্রুত বংশ বৃদ্ধি হয়।
- পাতার নীচে লক্ষ্য করলে ছত্রাকের বৃদ্ধি খালি চোখেই দেখা যায়।
- ফলে পাতা আকারে ছোট হয়ে যায়।
- এ রোগ পরবর্তীতে সরিষার ফল আক্রমণ করে।
- ফল ও বীজ হতে খাদ্য গ্রহণ করায় উৎপাদন বহুলাংশে কমে যায়।
- বেশী আক্রান্ত হলে গাছ শুকিয়ে যায়।
|
|
|
|
চিত্র: সরিষার ডাউনি মিলডিউ রোগের লক্ষণ |
রোগের প্রতিকার
- পূর্ববর্তী ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা এবং আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে।
- মেটালেক্সিল + মেনকোজেব (যেমন-রিডোমিল গোল্ড) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
- চারা অবস্থা থেকে সুষম সার ব্যবহার ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- জমিতে রোগ দেখা মাত্র মেটালেক্সিল + মেনকোজেব (যেমন-রিডোমিল গোল্ড) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
গাছ পঁচা বা হোয়াইট মোল্ড (Plant rot or White mold) রোগ
রোগের কারণ
স্ক্লেরোটিনিয়া স্ক্লেরোশিওরাম (Sclerotinia sclerotiorum) নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
রোগটি মাটি বাহিত। আর্দ্র আবহাওয়া রোগ বিস্তারের অনুকুল অবস্থা। বাতাসের তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সেঃ ছত্রাকের এসকোস্পোর অংকুরোদগমের জন্য অনুকুল এবং মাটির তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রি সেঃ রোগ তৈরীর জন্য অনুকুল পরিবেশ।
রোগের লক্ষণ
- মাটির সাথে লেগে থাকা কান্ড ও পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়।
- আক্রান্ত টিসু পানি ভেজা, বাদামী রংগের ও নরম পচা হয়।
- আক্রান্ত কান্ডের ভিতরে ও বাহিরে ছত্রাকের সাদা মাইসেলিয়া এবং কালো দানার মত স্কে¬রোশিয়া লক্ষ্য করা যায়।
|
|
|
|
চিত্র: সরিষার হোয়াইট মোল্ড রোগের লক্ষণ |
রোগের প্রতিকার
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
- জমিতে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- পূর্ববর্তী ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা এবং আবর্জনা পুড়ে ফেলতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (যেমন-অটোস্টিন) অথবা কার্বোক্সিন + থিরাম (যেমন-প্রোভ্যা* ২০০ ডব্লিউপি) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।
- মাটি ভিজা স্যাঁতস্যাতেঁ রাখা যাবে না।
- এই ছত্রাকটি সাধারণত মাটির উপরিভাগে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সুতরাং মাটিকে গভীর চাষের মাধ্যমে রোগের উৎস নষ্ট করে আক্রমণ কমানো যায়।
- অর্ধকাচা মুরগির বিষ্ঠা হেক্টর প্রতি ৫ টন হারে বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ আগে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (যেমন-অটোস্টিন) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর গাছের গোড়াসহ সমস্ত গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
সূত্র ও লেখকঃ বিজ্ঞানী ড. কে. এম. খালেকুজ্জামান