মাছের নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রীকে প্রধানত দু’ ভাগে ভাগ করা যায় — প্রাকৃতিক খাদ্য ও পরিপূরক খাদ্য বা কৃত্রিম খাদ্য।
পুকুরে বা জলাশয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে এক ধরনের খাদ্য উত্পন্ন হয়। এদের প্রাকৃতিক খাদ্য বলে। এরা খুব ছোট ছোট হয় এবং জলের ঢেউ যে দিকে যায়, এদের গতিও সে দিকে হয়। এই প্ল্যাঙ্কটন দু’ ধরনের হয় —
জলে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ জাতীয়কণাকে উদ্ভিদকণা বলে। পুকুরে জলের রঙ সবুজ হলদে বা সবুজ বাদামি হওয়ার জন্য এই উদ্ভিদকণা। এরা মাছের আদর্শ খাদ্য।
প্রাণীজাত সব ধরনের প্ল্যাঙ্কটনকে ‘জুপ্ল্যাঙ্কটন’ বলে। এরা আকৃতিতে উদ্ভিদকণা অপেক্ষা বড়। একটি পরিষ্কার স্বচ্ছ বোতলে পুকুরের জল নিয়ে দেখলে দেখা যায় যে এরা নাড়াচড়া করেছে। পুকুরে প্রচুর পরিমাণে প্রাণীকণা জন্মালে জলের রঙ ধূসর সাদাস হালকা বাদামি বা হালকা কালো দেখায়। এরা ডিমপোনা বা ধানি পোনার প্রধান খাদ্য। রটিফার নামক এক ধরনের অনুবীক্ষনিক নিম্ন প্রাণী জলাশয়ে দেখা যায়। এরা হল মাছের প্রিয় খাদ্য এবং মাছ চাষের পুকুরে যাতে এই সব প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মায় সে দিকে নজর দিতে হবে।
পুকুরে শৈবাল আধিক্যের জন্য কী ক্ষতি হয় ?
আমরা বদ্ধ জলাশয় অর্থাৎ দিঘি, পুকুর, ডোবা ইত্যাদিতে যখন মাছ চাষ করি এবং তাতে অধিক পরিমাণে মাছ ছেড়ে তাদের প্রতিপালন করি তখন শুধু প্রাকৃতিক খাদ্যের উপর ভিত্তি করলে চলবে না। তাদের বাইরে থেকে তৈরি করা খাবার দিতে হয়। এ ছাড়া শুধু প্রাকৃতিক খাবারের উপর নির্ভর করলে মাছের সম্পূর্ণ পুষ্টিও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এ ছাড়া প্রাকৃতিক খাবার উপযুক্ত পরিমাণে তৈরির জন্য জলাশয়ে মাছের খাবারের সাধে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগেরও প্রয়োজন হয়। জৈব সারের মধ্যে গোবর ও গোবর সার, কম্পোস্ট, কেঁচো সার, নানা রকম খইল ইত্যাদি। অজৈব সারের মধ্যে অ্যামোনিয়াম সালফেট, ইউরিয়া, সিঙ্গল সুপার ফসফেট, মিউরিয়েট অব পটাশ ইত্যাদি। নিয়মিত চুন প্রয়োগ মাছের স্বাস্থ্য, জলের শুদ্ধতা ও মাছের খাবার তৈরির ক্ষমতা বাড়ায়।
চাষযোগ্য মাছের পুষ্টিতে প্রায় দশ রকমের অ্যামাইনো-অ্যাসিড দরকার হয়। তাই এদের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো-অ্যাসিড বলা হয়। যেমন, আরজিনাইন, হিস্টিডিন, আইসোলুসিন, লুসিন, লাইসিন, মিথিওনাইন, ট্রিপটোফান, ফিন্যাইল্যানিন, থিরিওনাইন ও ভ্যালাইন। পরিপূরক খাদ্যে উক্ত প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো-অ্যাসিড যথাযথ মাত্রায় থাকা উচিত। মাছের খাদ্যে প্রোটিনের মাত্রা শতকরা ৩৫ ভাগ থাকা উচিত। প্রোটিনের পর কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাদ্য মাছের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। এই কার্বোহাইড্রেট শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যে শরীরের শক্তি উৎপন্ন হয়। আবার প্রয়োজনে অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্লাইকোজেন রূপে যকৃতে সঞ্চিত হয় বা দেহের মাংসপেশিতে জমা হয়। প্রায় প্রতি গ্রাম কার্বোহাইড্রেটে ৪ কিলোগ্রাম ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। মাছের পরিপূরক আহারে শতকরা ১০.৫ ভাগ কার্বোহাইড্রেট থাকা উচিত। কার্বোহাইড্রেট ছাড়াও মাছের দেহে পুষ্টির জন্য ফ্যাট বা চর্বি থাকা প্রয়োজন। খাদ্য ৪-১৮ ভাগ চর্বিযুক্ত হওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনীয় ফ্যাট, যেমন কলিন, মিথিওনাইন ও টোকোফেরল প্রভৃতি মাছের খাদ্যে থাকা উচিত।
উপরের তিন প্রধান উপাদান ছাড়াও মাছের দেহে পুষ্টির জন্য নানা খনিজ পদার্থের আবশ্যকতা আছে, যেমন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাস, ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, আয়োডিন, ফেরাস প্রভৃতি। ভিটামিন মাছের পরিপূরক আহারের এক অন্যতম উপাদান হওয়া দরকার। ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন ই (রাইবোফ্লাবিন, পাইরিডক্সিন, পানফেবিনেট, নিয়াসিন), ভিটামিন বি ১২, ডি ও ভিটামিন কে অতি অন্যতম।
মাছের প্রধান প্রাণীজাত পরিপূরক খাদ্য হল মাছের গুঁড়ো। রেশমকীটের পিউপা, পশুর নাড়িভুঁড়ি, কসাইখানার ছাঁট মাংস ও রক্ত প্রভৃতি। আবার উদ্ভিদজাত খাদ্য হল সরষের খোল, বাদাম খোল, সয়াবিন চূর্ণ, চালের কুঁড়ো, গমের ভুষি, বার্লি। রাই ইত্যাদি।
আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক মাছ চাষের পদ্ধতিতে সর্বাধুনিক সংযোজন হল বাইরে থেকে জোগান দিয়ে মাছকে সরাসরি পুষ্টিকর কৃত্রিম খাদ্য খাওয়ানো।
সার প্রয়োগের ফলে পুকুরে সৃষ্ট প্রাকৃতিক খাদ্য মাছের দ্রুত বৃদ্ধির পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। তাই মাছের দ্রুত বৃদ্ধি তথা মাছের ফলন উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধির জন্যই আজকাল সব দেশেই মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিপূরক হিসাবে নানা রকম পুষ্টিকর কৃত্রিম খাদ্যের জোগান দেওয়া হয়।
মাছের কৃত্রিম খাদ্য নির্বাচনে যে বিষয়গুলি বিচারবিবেচনা করে দেখতে হয় সেগুলি হল —
মাছের কৃত্রিম খাদ্য হিসাবে উদ্ভিদজাত ও প্রাণীজাত বিভিন্ন রকমের বস্তুর ব্যবহার বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। তবে আমাদের দেশে এর ব্যবহার খুব বেশি দিন আগের নয়। প্রচলিত প্রাণীজাত খাদ্যের মধ্যে প্রধান বস্তুগুলি হল, ফিসমিল বা মাছের গুঁড়ো, রেশমকীটের পিউপা, ভেড়া ছাগলের নাড়িভুঁড়ি, কসাইখানার ছাঁটমাংস, রক্ত ইত্যাদি। উদ্ভিদজাত খাদ্যের মধ্যে বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয় সরষের খোল, বাদাম খোল, সয়াবিন চুর্ণ, চালের কুঁড়ো, গমের ভূষি, জলে ভেজা বা অন্য ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও মানুষের খাওয়ার অযোগ্য চাল, ডাল, গম ইত্যাদি। প্রাণীজাত খাদ্যের মধ্যে ফিসমিল, পিউপা আমাদের দেশে মোটেই সহজলভ্য নয়। স্বল্প মূল্যে তো নয়ই। কসাইখানার নানা রকম আবর্জনা সংগ্রহ করা সর্বত্র সহজ নয়। এই সব কারণে আমাদের দেশে মাছের কৃত্রিম খাদ্য হিসাবে প্রাণীজাত খাদ্যের ব্যবহার এখনও বিশেষ প্রচলিত হয় নি।
উদ্ভিদজাত খাদ্যের মধ্যে সহজলভ্যতা ও স্বল্প মূল্যের বিচারে আমাদের দেশে সাধারণত চালের কুঁড়ো ও সরষের বা বাদাম খোল সমান অনুপাতে মিশিয়ে পরিপূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এতে উত্পাদন ব্যয়ও অনেকটা কমে। বাদাম খোলের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি তাই সরষের খোলের ব্যবহারটাই অধিক প্রচলিত।
বিভিন্ন ধরনের চাষে বিভিন্ন মাত্রায় কৃত্রিম খাদ্য ব্যবহার করতে হয়। যেমন —
হিসাব অনুযায়ী দৈনিক যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ খাদ্যবস্তুকে মোটামুটি সমান দু’ ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। একটি ভাগ থাকবে শুকনো অবস্থা এবং অপর ভাগটি জলে মাখা অবস্থায় মণ্ড করা। এই বার পুকুরপাড় থেকে কিছুটা দূরে নির্দিষ্ট ২-৩ জায়গায় অল্প অল্প করে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে জলের ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে। এই ভাবে সকালের দিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য দেওয়া হলে দেখা যাবে যে পুকুরের প্রায় সব মাছই ওই সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ভিড় করছে। মনে রাখা দরকার, সময়সূচি মেনে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
জলাশয়ের ক্ষেত্রফল বড় হলে খাবারের থলি (পরিমাণমতো চটের থলি বা ছোট ঝুড়িতে) ভাসমান অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ছোট নৌকা বা ভেলা বা ডিঙির সাহায্যেও এই কাজ করা যেতে পারে।
প্রাপ্তি স্থান : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/29/2020