আমি ২০০১ সালের ১৬ জানুয়ারি মালদা চক্রের অন্তর্গত চিরাহুরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করি। শিক্ষকতা করার মানসিকতা বরাবরই ছিল। কিন্তু এত সহজ ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সুযোগ পাব ভাবতেই পারিনি। কারণ জানা ছিল চাকরি পেতে গেলে টাকা অর্থাৎ ঘুষ দিতে হয়। কিন্তু আমাকে পাঁচটি পয়সাও দিতে হয়নি। তাই ধন্যবাদ জানাই আমার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। তার নীতি নির্ধারণ নিয়মকে। যাক সে সব কথা, এ বার আসা যাক মূল স্রোতে।
আমার বিদ্যালয়ে এমন এক সময় ছিল, যেখানে আমি একা শিক্ষক ছিলাম। অর্থাৎ আমিই ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং সাধারণ শিক্ষক। সেই সময় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১১৬ জন। বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ৬ জন। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৬৪ জন। শিক্ষক ছাত্র অনুপাত ১ : ১১ (প্রায়)। পঠনপাঠনে আগের তুলনায় একপ্রস্থ উন্নতি হলেও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। ভেবেছিলাম শিক্ষক সংখ্যা বাড়লেই পঠনপাঠনে উন্নতি হবে। তা হয়নি। যখন কর্মশালায় লেখার সুযোগ পেয়েছি তখন সত্য কথাই বলব।
শিক্ষকতার লোভ বরাবরই ছিল এ কথা আগেও বলেছি। কিন্তু শিক্ষক হওয়া যে সহজ কথা নয়, এটা এখন বুঝতে পারছি। কত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি যে গ্রামের শিক্ষক তা আমার বাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে। সাইকেল চালিয়ে যেতে হয়। গ্রামটির নাম চিরাহুরি। গ্রামের প্রতিটি পরিবার মুসলিম। মালদা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের লোকজন অশিক্ষিত। শতকরা নব্বই ভাগ লোক বাম হাতের বুড়ো আঙুলে টিপ সই দিয়ে থাকেন। এ হেন গ্রামে শিক্ষকতা করে কিছু চেষ্টাও চালিয়েছি কিন্তু আশানুরূপ ফল পাইনি। গ্রামের বিদ্যালয়ে ১১টায় প্রার্থনা শুরু করি। দেখা যায় গুটিকতক ছাত্রছাত্রী প্রার্থনা লাইনে আছে। প্রার্থনা শেষে ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে। আমরা নাম ডাকার খাতা হাতে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করার পর বাকি ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে। অভিভাবক ও অভিভাবিকাদের সঙ্গে অনেক সভা করা হয়েছে। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, তাঁরা ঠিকঠাক সময়ে ছেলেমেয়েদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাবেন। প্রথম দু’ চার দিন সব ঠিকঠাক। তার পর ঐ পূর্বের অবস্থা। কোনও ছাত্রছাত্রী না আসলে আমি বা আমরা ঐ ছাত্রছাত্রীর বাড়ি সঙ্গে সঙ্গে যাই। অভিভাবক এবং অভিভাবিকাদের ছাত্রছাত্রীদের কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা উত্তর দেন ‘এ তো ছিল, কোথায় যে গেল, বলতে পারছি না।’ কোনও বাবা বলেন, গরু চরাতে গেছে, কোনও মা বলেন, ধান কুড়োতে গেছে।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/22/2020