লাল মোরামের আঁকা বাঁকা রাস্তা। সবুজ গাছগাছালিতে ছাওয়া। আম, কলা, জামরুল গাছের সারি দেওয়া শান বাঁধানো পুকুর। মোরামের আঁকা বাঁকা রাস্তা যেখান শেষ, বিদ্যালয়টি সেখানে। গ্রামের নাম জেঠিয়া, বিদ্যালয়ের নাম ২৭, জেঠিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথগঞ্জ চক্র। আমার কর্মজীবনের শুরু ১৯৯৫ সালে। প্রাকৃতিক পরিবেশে আনমনা করে দেওয়া অনুভবে বিদ্যালয়টিকে প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেললাম।
বিদ্যালয়ের পেছনে সুন্দর একটা মাঠ, তার পর আলজমি, ক্যানেল, আরও একটু দূরে রেল লাইন। রেল লাইন পেরিয়ে গেলেই মির্জাপুর সাগরদিঘি যাবার বাদশাহী সড়ক। সারি সারি ইউক্যালিপ্টাস গাছ। ছবির মতো সুন্দর।
রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি শিক্ষার অনুভবে আলোকিত হয়ে ভাবলাম, শিক্ষার কাজটায় যতটা পারব ততটাই প্রকৃতিকে ব্যবহার করব। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একটি পাঠের ভাবনা মনে মনে করে নিয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছেলেমেয়েদের ডেকে নিলাম।
বিদ্যালয়ে পৌঁছনোর আগেই ওরা এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যেতেই মিলন, সুব্রত, বংশী, বাদল, রীতা, কৌশিক, ছবি, শাপলা আমাকে ঘিরে ধরল। কলবল করে উঠল ওরা, স্যার, স্যার মেলা দেখাতে নিয়ে যাবেন না? আমি বললাম, তোমরা তৈরি? ওরা এক সঙ্গে উত্তর দিল, হ্যাঁ!
আসলে, ‘Geography : A sense of Place’ এবং ‘History : Making Connection’ এর উপর হাতে কলমে কাজ করব বলে ওদের ডেকে নিয়েছিলাম।
তোমরা সবাই খাতা পেন এনেছো, জিজ্ঞেস করাতে হাতে তুলে দেখিয়ে দিল। আর কী? চলো বেরিয়ে পড়ি, ওরা হই হই করে উঠল। প্রকৃতির অন্তর্লীন ভালোবাসায় ওদের মুখগুলো চকচক করে উঠল।
মোরামের রাস্তা ধরে গ্রামের শেষ প্রান্তে এলাম। এখানে একটা পুরনো পুকুর আছে, চার দিকটা বাঁধানো, দু’ দিকে ভেঙে যাওয়া সিঁড়ি। জলে নেমে গেছে। অনেক জায়গায় শ্যাওলা পড়েছে। পা টিপে টিপে আসতে বললাম। গাছগাছালিতে জায়গাটা ঢাকা, সিঁড়ি পাদানিতে ক্ষয়ে যাওয়া অস্পষ্ট পাথরে কালো কালো অক্ষরে কিছু লেখা। শুকনো পাতা সরিয়ে ওদের পড়তে বললাম। থেমে থেমে আধো স্বরে একটু একটু করে পড়তে লাগল। স্যার, লেখা আছে — ‘মাতা সৌদামিনী দাসের স্মৃতিতে ছেলে পঙ্কজ দাস এই পুষ্করিণী খনন করিল। সাল — ১৮৯৩।’
‘স্যার ১৮৯৩, অনেক দিন আগের না?’ অবাক বিষ্ময় ওদের চোখে।
হেসে ফেললাম। বললাম ‘ অ–নে–ক দিন আগে এই পুকুরটা খনন করা হয়েছিল। ধর প্রায় ১০৫ বছর আগে।’ তারা Note book-এ এ কথা লিখে নিল। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কিছু আবিষ্কারেরর একটা আনন্দ। খুব সংক্ষেপে পঙ্কজ দাস সম্পর্কে বললাম। ওরা সেগুলো নিল।
পঙ্কজ দাস জেঠিয়া অঞ্চলের জমিদার ছিলেন, সেই বিষয়টিতে বেশ আগ্রহ দেখালাম। অনেকে বলল, স্যার, দফরপুর গ্রামে ভাঙা জমিদার বাড়ি দেখেছি। অনেকে বলল, স্যার, ঐ বাড়িতে ভূত থাকে। হেসে ফেললাম। বললাম, তা নয়, পুরনো বাড়ি তো! সাপ–খোপ থাকে, তাই বড়রা ভূতের ভয় দেখায়। কেন তোমরা ‘বিবেকানন্দের ছেলেবেলাতে’ বন্ধু রামরতন বাবু আর ব্রহ্মদত্যির ভয় দেখানো গল্প পড়েছ না! ওরা হই হই করে সমর্থন জানালো।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/9/2020