বাংলা ভাষার ব্যবহার বৈষ্ণব আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করে চৈতন্যদেব বৈষ্ণব আন্দোলনকে আরও বাস্তবমুখী ও বেগবান করে তোলেন। উচ্চ বর্গের হিন্দু সম্প্রদায় সংস্কৃতকে এবং মুসলমান সম্প্রদায় আরবি-ফারসিকে শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যম করায় বাংলা ভাষা প্রায় দু-তিনশো বছর উপেক্ষিত ছিল। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষায় কোনও কিছু রচনা বা অনুবাদ করাকে অধর্মের কাজ বলে মনে করা হত। শ্রীচৈতন্য এবং তাঁর পার্ষদদের অনেকে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন এবং তাঁরা সংস্কৃতে বিভিন্ন গ্রন্থও রচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা বৈষ্ণব প্রেমভক্তিবাদ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ ও প্রচার করেন। বৈষ্ণব কবিগণ তাঁদের পদগুলিকে অধ্যাত্ম সাধনার অঙ্গরূপেই মনে করতেন। ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত অসংখ্য বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি চৈতন্য ও মোহান্তগণের বিশালাকার চরিতকাব্য, কিছু কড়চা ও শাস্ত্রকাব্যও রচিত হয়েছে। ফলে বৈষ্ণব আন্দোলন শক্তিশালী ভিত্তি ও গতিবেগ লাভ করে। দীনেশচন্দ্র সেন শ্রীচৈতন্যের সমকাল ও উত্তরকালে ১৬৪ জন বৈষ্ণব পদকর্তার নাম করেছেন, যাঁদের রচিত পদসংখ্যা ৪,৫৪৮টি। এ ছাড়া শতাধিক বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবিও ছিলেন।
আঠারো শতকে পদকল্পতরু, পদামৃতসমুদ্র, রসমঞ্জরী, গীতচিন্তামণি, পদকল্পলতিকা ইত্যাদি সংকলন-গ্রন্থে অসংখ্য বৈষ্ণবপদ সংকলিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্য ও মোহান্তদের জীবনীগ্রন্থগুলি (চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যমঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত, ভক্তিরত্নাকর ইত্যাদি) একাধারে জীবনী, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন ও সমাজকথার দলিলরূপে বিবেচিত। জীবনচরিত ও তত্ত্বকাব্যে বৈষ্ণবদের বুদ্ধিবৃত্তির সূক্ষ্মতা ও জ্ঞানের গভীরতার ছাপ রয়েছে। এ ভাবে চৈতন্যদেবের জীবন ও কর্মকে কেন্দ্র করে একটি শিক্ষিত বৌদ্ধিক শ্রেণির বিকাশ চৈতন্যদেব স্থবির হিন্দু সমাজকে কেবল গতিশীলই করেননি, তিনি সে সমাজকে সৃষ্টিশীল করে তুলেছিলেন। বৈষ্ণব আন্দোলনের এরূপ সাংস্কৃতিক সাফল্য সমকালের অন্য কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না। সুফিরাও অধ্যাত্মসাধনার কথা প্রকাশ ও প্রচার করার জন্য বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস বৈষ্ণবদের মতো এত সুসংগঠিত ও সম্প্রসারিত ছিল না।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, amadernangalkot.com,thesundayindian.com
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/9/2020