“তপ্ত তৃষায় চঞ্চু করি ফাঁক
প্রাচীর -’পরে ক্ষণে ক্ষণে বসতো এসে কাক।
চড়ুই পাখির আনাগোনা মুখর কলভাষা
ঘরের মধ্যে কড়ির কোণে ছিল তাদের বাসা।”
——–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(বালক)
আজ-কাল স্কুলে পড়ার সময়ের গরমের ছুটির দুপুরগুলো খুব মনে পড়ে। আমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে মা যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত তখন বন্ধ দরজা-জানালার অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলোর দিকে চেয়ে থাকতাম। আমার চঞ্চল মনের সাথি ছিল ঘুলঘুলিতে বাসা করে বেঁধে থাকা আমারই মতো চঞ্চল কিছু চড়ুই। ইদানীং দুপুরবেলা যখনই ওদের কথা মনে পড়ে তখনই অবাক লাগে, কই এখন তো আগের মতো চড়ুই দেখতে পাই না। শুধু চড়ুই নয় অনেক পাখিই এখন আর খুব বেশি চোখে পড়ে না। মানুষের যথেচ্ছ শিকারের জন্য ডোডো পাখি কী ভাবে পৃথিবীর বুক থেকে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে সে ঘটনা নিশ্চয়ই তোমাদের অনেকের জানা। কিন্তু এ খবর কি রাখো যে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেশন (আইইউসিএন)-এর হিসেব মতো বিপন্ন পাখিদের মধ্যে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে ভারতের চোদ্দটি ভিন্ন প্রজাতির পাখি। পক্ষীবিশারদরা চিহ্নিত করেছেন নানান কারণ। পাখিদের বাসস্থান সমস্যা, পরিবেশে যথেচ্ছ ক্ষতিকারক কৃত্রিম রাসায়নিক/কীটনাশক প্রয়োগ, যত্র-তত্র শিল্পস্থাপনের জন্য কৃষিজমি বা বনভূমির ধ্বংস, এ সবই সংকটে ফেলেছে পাখিদের অস্তিত্বরক্ষায়। চড়ুইয়ের কথাই ধরা যাক, গত দশ বছরে এদের সংখ্যা এত কমে গেছে যা ভাবলেই অবাক লাগে ! চড়ুই হচ্ছে ঘরোয়া পাখি, ঘুলঘুলি, টালির চাল, ছোট-ছোট গাছেই এরা বাসা বেঁধে থাকে। শহুরে মানুষের বাসস্থানের প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের ফলে সেখানে ঘুলঘুলির বা টালির চালের ফাঁক-ফোকরের অভাব বেড়ে গেছে আর কমেছে গাছের সংখ্যা। ফল এই যে, এরা বাসা করে থাকতে পারছে না আর বংশবিস্তারে পড়ছে বাধা। কেউ কেউ মোবাইল ফোনের টাওয়ার অত্যধিক সংখ্যায় বৃদ্ধি এবং ফলস্বরূপ তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের মাত্রাধিক বিস্তারের কারণকেই দোষী ঠাওরাচ্ছেন। অন্য দিকে ভারতীয় শকুনের কাছে সমস্যা হচ্ছে গবাদি পশুর ওপর অত্যধিক মাত্রায় ওষুধের প্রয়োগ। ইতিমধ্যে পরিবেশবিদরা চিহ্নিত করে ফেলেছেন যে গবাদি পশুদের ওপর অতিমাত্রায় Diclofenac (এই ওষুধ ব্যথা দূর করতে আমরাও খাই) ওষুধটিকে প্রয়োগ করার ফলই হল শকুনের অস্তিত্ব সংকটের মূল কারণ। মৃতপশুদের দেহ খেতে গিয়ে তাদের শরীরে প্রবেশ করছে খাদ্যের মধ্যে সঞ্চিত থাকা Diclofenac আর তা তাদের শরীরের নানান জৈবনিক ক্রিয়ায় সৃষ্টি করছে বাধা (kidney failure) এবং পরিণামে অকালমৃত্যু। ফসল ও খাদ্যশস্যের ফলনের জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক এর প্রভাবে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে অনেক পাখি। অনেকেই বলতে পারো মশাই পাখিরা কী কাজে আসে যে তাদের রক্ষার জন্যে এত জোর দিতে হবে ! হ্যাঁ, এই বার বুঝতে হবে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় পাখিদের অপরিসীম ভূমিকার কথা। ফুলের থেকে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে পরাগসংযোগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পোকা-মাকড় খেয়ে আমাদের কী অসাধারণ ভাবে উপকার করে তা আমরা হয়ত অনেকেই জানি না। বহুগাছের বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তার শুধু পাখিদের জন্যই হয়ে থাকে। পাখিদের বিষ্ঠা ত্যাগের সময় অপাচ্য ফলের বীজ ছড়িয়ে প্রতক্ষ্য ভাবে যে বন্যগাছের বংশবিস্তারে সহায়তা করে তা আমরা জীববিজ্ঞানের বইতে সবাই পড়েছি। এ বার আসি ঝাড়ুদার পাখি মানে যারা মৃত পশু-পাখির দেহাবশেষ খেয়ে বেঁচে থাকে, যেমন শকুন। জানো কি এরা যদি না থাকে তবে এই সব মৃতদেহের থেকে ছড়িয়ে পড়বে অ্যানথ্র্যাক্স, প্লেগ বা র্যাবিসের মতো প্রাণনাশক জীবাণু। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত এ বার অনেকেই বেশ নড়ে-চড়ে বসেছো, মনের ভেতরে প্রশ্ন তা হলে আমাদের ঠিক কী করা উচিত? চিহ্নিত কারণগুলো তো আগেই বলেছি। তাই সেগুলো যে বন্ধ করতে হবে তাই আর নতুন করে কিছু বলছি না। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু ওদেরই নয় আমাদেরও। তাই আরও বেশ কয়েক রকম ভাবে আমরাও আামাদের পরিবেশের আশে-পাশে যে সব পাখিদের যাতায়াত তাদের কিছুটা উপকার করতে পারি। যেমন ধরো বারান্দায় বা গাছে পুরনো বাক্স বা হাঁড়ি ঝুলিয়ে তাদের শান্তিতে থাকার কিছুটা ব্যবস্থা তো আমরা করতেই পারি। প্রচণ্ড গরমের দিনে ঘরের বাইরে একটা পাত্রে জল রেখে দাও, পারলে কিছু খাবারও। দেখবে কি আনন্দে ওরা সেই জল-খাবার খাবে আর নেচে-নেচে, ঘুরে-ঘুরে, নানান সুরে ডাকতে-ডাকতে, সেই জলে চান করে যাবে।
ছবি : তন্ময় দাস (টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, মুম্বই )
সূত্র: কুণাল চক্রবর্তী, ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস, বেঙ্গালুরু, bigyan.org.in
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/24/2019