গত এক দশক ধরে শিক্ষাবিদ ও নীতি রচয়িতাদের কাছে সমান ভাবে নতুন করে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে অপ্রথাগত অর্থনীতি (বিশেষ করে ১৯৭০-এর দশকের পর এই বিষয়ের উপর আগ্রহটা বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছে)। যা কিছু অপ্রথাগত তা নিয়ে যে এই নতুন করে আগ্রহ তার পুরোভাগে রয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (ইন্টার ন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন, আইএলও) এবং ভারত।
এ দিকে ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে অপ্রথাগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আইএলও-এর প্রাথমিক আগ্রহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে ২০০০ সালের প্রথম দশকের প্রথম পর্বে এক সাবধানি পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে, ভারত সরকার এই সমস্যার প্রতি মনোযোগ দেয় অনেক দেরিতে। মাত্র ২০০৪ সালে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উদ্যোগগুলির জন্য একটি জাতীয় কমিশন (ন্যাশনাল কমিশন ফর এন্টারপ্রাইজেস ইন দ্য আনঅর্গানাইজড সেক্টর) গঠন করা হয়।
দেরি করে শুরু হলেও দেশের অপ্রথাগত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ট অংশের জন্য সংসদ একটি সামাজিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করেছে। দেশের অপ্রথাগত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের দুর্দশা মোচন ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাই ‘অসংগঠিত শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা আইন ২০০৮’-এর লক্ষ্য। ইতিমধ্যে আইএলও অপ্রথাগত থেকে প্রথাগত অর্থনীতিতে পর্যান্তরের এক নীতি রচনার (খুব সম্ভবত এক নথি তৈরি) প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে (যারা বেশির ভাগই দক্ষিণের বাসিন্দা) সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকের সঙ্গে জড়িত আইএলও-র এই উদ্যোগটি নিয়ে ভাবা দরকার। ভারতের ক্ষেত্রে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল ৯০ শতাংশেরও বেশি কর্মীর প্রত্যেককে অপ্রথাগত থেকে প্রথাগত ক্ষেত্রে যাওয়ার ব্যাপারে প্রেক্ষাপট এবং লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার আগে বুঝে নেওয়া দরকার ‘অপ্রথাগত’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে ‘অপ্রথাগত’ এই ধারণাটির তত্ত্বগত এবং নীতি সম্পর্কিত কার্যকারিতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি কর্মীদের প্রেক্ষাপট থেকে এই ধারণাটি একটু সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করছি।
‘অপ্রথাগত’ এই সীমারেখার মধ্যে আমি পারিশ্রমিকবিহীন কাজকে সামাজিক ভাবে মূল্যবান কাজের স্বীকৃতি দিয়ে একে অপ্রথাগত কাজের একটি শ্রেণি বলে গণ্য করার প্রস্তাব করছি। যাই হোক, নীতিগত ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে অপ্রথাগত ক্ষেত্রের প্রতিটি শ্রেণির উপর আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন এবং নীতি রচনার প্রক্রিয়ায় কর্মীদের স্বার্থকেই সবচেয়ে প্রাধান্য দেওয়া দরকার।
ঘানাতে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ কীথ হার্টের সমীক্ষা থেকে অপ্রথাগত ক্ষেত্রের ধারণাটিকে বেশ চটজলদিই গ্রহণ করেছে (বলা ভালো জনপ্রিয় করে তুলেছে) আইএলও। ব্রিটেন (ইউকে) থেকে ঘানায় এসেছিলেন হার্ট। ব্রিটেনে যেখানে সমস্ত শিল্প আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের অধীনে উন্নততর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বাঁধা থাকে সেখানে ঘানার মতো দেশে যে ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয় তা হার্ট-এর কাছে বেশ অদ্ভুত ঠেকিছিল। ঘানার শহরাঞ্চলে পথবিক্রেতা, বা অন্যান্য ঠিকে মজুরদের কাজকর্মকে তিনি যখন ‘অপ্রথাগত’ আখ্যা দিয়েছিলেন তখন তাঁর অভিজ্ঞতায় ব্রিটেন এবং অন্যান্য শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী দেশগুলির উদাহরণই কাজ করছিল। তাঁর মতে, ঘানার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে হেতু ব্রিটেনের শিল্পের মডেলের নির্দিষ্ট গঠনের সঙ্গে খাপ খায় না তাই সেই সমস্ত কর্মকাণ্ড ‘অপ্রথাগত’ ( হার্ট ২০০৬; ২১- ২৩ )।
এই ভাবেই একটা গঠনের মতবাদ থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘অপ্রথাগত’ – এই ধারণা। যদিও এখানে ‘গঠন’ বলতে এক ধরনের বিশেষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। যে বিশেষ ধরনের গঠনের ভিত্তিতে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটি গড়ে উঠেছে তা কিন্তু শুধুমাত্র একটা আঙ্গিক বা মডেল মাত্র। এই মডেল হল— সুস্পষ্ট ভাবে শনাক্তকরণযোগ্য নিয়োগকারী ও কর্মচারীর সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নির্দিষ্ট কর্মস্থল, তথা অধিকার ও কর্তব্যভিত্তিক এবং সরকারি তত্ত্বাবধানে চলা এবং একটি সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ সময়ে গঠিত এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মডেল।
তখনকার এবং এখনকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই সেই সমস্ত সংগঠিত কাজের মডেলের সঙ্গে খাপ খেত না এবং এখনও খাপ খায় না। ওই মডেলে আজকের বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মীর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে না (আগেও ঘটত না)। তা হলে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছব যে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটি কোনও মতাদর্শগত এবং নীতি সংক্রান্ত কোনও উদ্দেশ্য পূরণ করে না?
এই ধারণার মধ্যে নিহিত এক পূর্ব পক্ষপাতদুষ্টতা এবং নেতিবাচক (যেমন প্রথাগত নয়) আভাস সত্ত্বেও এই অপ্রথাগত ধারণাটিকে শিক্ষা বা নীতি সংক্রান্ত পরিসর থেকে বাদ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য পূরণ করে।
এর প্রথম এবং প্রধান কার্যকর উদ্দেশ্যটি যুক্ত রয়েছে এর সঙ্গে জড়িত থাকা নেতিবাচক ধারণার সঙ্গেই। তত্ত্বগত ভাবে যখন কোনও বিষয়কে প্রথাগত নয়, বা অস্বাভাবিক বলে তকমা দিয়ে দেওয়া হয় তখন তার মধ্যে একটা অদ্ভুত চালিকাশিক্ত চলে আসে। ভারতের শ্রমিক শ্রেণির ৯০ শতাংশই অপ্রথাগত ক্ষেত্রে নিযুক্ত, এই বিবৃতিই যেন একটা ‘বিপদ ঘণ্টি’র মতো শোনায়। এই সব তত্ত্ব বা আলংকারিক কথাবার্তা অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটি ভীষণ ভাবেই উপযোগী।
দ্বিতীয়ত, অপ্রথাগত ধারণাটি আবার সুবিধাপ্রাপ্ত এবং নিরাপত্তাহীন শ্রমিকদের মধ্যে পার্থক্যও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত, এই ধারণা একটা আদর্শের কথা তুলে ধরে— ঠিক কী ধরনের গঠন বা আঙ্গিকের পথে আমাদের যাত্রা করতে হবে (যদি সেই গঠনটিকেই নিয়েও নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হয় তা হলেও)।
চতুর্থত, শিক্ষা গবেষণা সংক্রান্ত আলোচনাও প্রতিবাদী আন্দোলন স্তরে এটি এগিয়ে চলার একটা ভাষা জোগায়। আর, সর্বোপরি অপ্রথাগত ধারণাটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে নীতি সংক্রান্ত কর্মসূচি তৈরিতে সাহায্য করে।
যা-ই হোক না কেন, কোনও নীতির নির্ধারক হিসাবে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটিকে গ্রহণ করার সবচেয়ে বড় সমস্যা এখানেই যে এই ধারণা যতটা প্রকাশ করে তার চেয়েও বেশি ধোঁয়াশায় ঢেকে রাখে। অপ্রথাগত কাজকর্ম যে কত ধরনের এবং কত বিচিত্র হতে পারে তা আমাদের ধারণার বাইরে! বিশেষ করে ভারতের মতো বৃহৎ দেশে অপ্রথাগত কাজকর্মের বৈচিত্র্যের শেষ নেই। তার সঙ্গে ভারতের প্রথাগত উদ্যোগগুলিও অপ্রথাগত লেনদেন ও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটির মধ্যে নানান ধরনের অপ্রথাগত কাজকর্মকে ঐক্যবদ্ধ করা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। নীতি সংক্রান্ত স্বার্থে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটির ধোঁয়াশা কাটানো প্রয়োজন এবং এই ধরনের কাজকর্মের বৈচিত্র্য বা অসমসত্ত্ব চরিত্রকে স্বীকার করে নেওয়া দরকার। এই অসমসত্ত্ব চরিত্র বা বৈচিত্রের স্বীকৃতির জন্য অপ্রথাগত ধারণাটি যথাযত নয়।
অপ্রথাগত ধারণাটি নিয়ে দ্বিতীয় সমস্যার সূত্রপাত এই শব্দ বা পরিভাষাটির অর্থোদ্ধার করা নিয়ে; যখন অপ্রথাগত এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হবে তখন এক জন তার কী অর্থ উদ্ধার করবে? এটা কি কোনও ক্ষেত্র; অর্থনীতি না কি কর্মসংস্থান? বহু দিন ধরে একটি ক্ষেত্র অর্থাৎ অপ্রথাগত উদ্যোগের ধারণা নিয়েই আইএলও-র চিন্তাভাবনা পরিচালিত হয়েছে। তার পরবর্তী সময়ে আইএলও অপ্রথাগত অর্থনীতি এবং অপ্রথাগত কর্মসংস্থানের মাপকাঠিগুলি বেঁধে দিয়েছে। অর্থনীতির অপ্রথাগত অংশের উত্পাদনশীলতা নির্ধারণ করা তথা দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর অবদান পরিমাপ করার লক্ষ্যে যখন অপ্রথাগত অর্থনীতির ধারণাটিকে প্রথাগত অর্থনীতির প্রথাগত – অপ্রথাগত দু’টি ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রথাগত বা অপ্রথাগত অর্থনীতিতে (বা ক্ষেত্র) তাদের নিয়োগ নির্বিশেষে শ্রমিকরা যে বিচিত্রমুখী কাজকর্ম (অপ্রথাগত) করছেন সে সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়ার জন্যই অপ্রথাগত কর্মসংস্থানের মতের প্রচলন হয়। ভারতে, নীতি সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলা দরকার যে আমরা যদি আমাদের সংবিধান ও তার মূলনীতির প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে চাই তা হলে অপ্রথাগত শর্তের ওপর বিশ্লেষণী মনোযোগ দিতে হবে।
নীতিগত উদ্যোগে শ্রমিকদের সামগ্রিক কল্যাণ— তাদের কাজের পরিবেশ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং আয় (অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে) ইত্যাদি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুরাহা থাকা প্রয়োজন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অপ্রথাগত কর্মসংস্থানের ধারণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে ঠিক একই সঙ্গে অপ্রথাগত কর্মসংস্থানের ধারণার মধ্যে কিছু নিয়ন্ত্রণও রয়েছে। এই ধারণার মধ্যে একটা কথাই রয়েছে যে বিভিন্ন ধরনের ‘অর্থনৈতিক’ কর্মকাণ্ড যেগুলো কি না প্রথাগত নয় — এখানে জোর দেওয়া হচ্ছে, অর্থনৈতিক শব্দটির ওপর। অপ্রথাগত এটি যে শুধু অর্থনীতির সমস্যা নয় বৃহত্তর সমাজের সমস্যা এই প্রকৃত সত্যটা এই ধরনের বোঝাপড়ার ফলে আমরা ভুলে যাচ্ছি।
একটি বিশেষ আঙ্গিকের বিপরীত প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে অপ্রথাগত ধারণটি জন্ম নিয়েছে— আর সেই বিশেষ গঠন বা আঙ্গিকটি শিল্প বিপ্লবের ফসল যা শিল্পের উপর আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং যা অবশ্যই লাভজনক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা বলে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, অপ্রথাগত ধারণাটিও এর পর উত্পাদনশীল বা (লাভজনক) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল।
যে ভাবেই হোক, শ্রমিকদের (অপ্রথাগত) কাজকর্ম যদি আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়, তবে সেই কাজকর্মকে যে সব সময় অর্থনৈতিক হতে হবে তার কোনও মানে নেই। অর্থনৈতিক নয় এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মও রয়েছে এর মধ্যে- যেমন পরিচর্যার কাজ, গ্রাসাচ্ছাদনের কৃষিকাজ, (কিছু বিশেষ ) গৃহস্থালির কাজ এবং বিনা মূল্যের পারিবারিক শ্রম। উপরোক্ত কাজগুলিকে অপ্রথাগত কাজ বলা যায় কি না তা নিয়ে একটা বিতর্ক থাকলেও প্রধান প্রধান নীতিগত উদ্যোগগুলিতে সাধারণ এই কাজগুলিকে অপ্রথাগত কর্মসংস্থান বলে গণ্য করা হয় না।
অন্য কোনও ভালো শব্দ না থাকায় এবং বোঝার সুবিধার্থে পূর্ববর্তী অংশে আমাকেও অপ্রথাগত শ্রমিকরা কোন কোন ধরনের কাজে যুক্ত তা তুলে ধরতে অপ্রথাগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শব্দবন্ধটি ব্যবহার করতে হয়েছিল। কিন্তু অবশ্যই অপ্রথাগত ধারণাটি শুধুমাত্র অর্থনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা বৃহত্তর সামাজিক এক ঘটনা, যার মধ্যে অর্থনীতিও রয়েছে। তবে আবার অর্থনীতির ধারণার মধ্যে সমাজের ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত না করার ব্যাপারেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, অনেক বৃহত্তর একটি ক্ষেত্র (বাজার সহ) এবং বাজার তার একটি অংশ (পোলানয়ি, ২০০১ : ৬০, ৭১- ৭৯; হার্ট এবং হান, ২৯৯০ )। অর্থনীতি বা বাজারই যদি সংশ্লিষ্ট সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত বিষয়ের একমাত্র নির্ধারক হয়ে ওঠে তা হলে আসল নীতি সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ বেশ সংকীর্ণ হয়ে যায় (স্টিগটিসটজ্ ২০০১ )।
অর্থনীতিকে শুধু মাত্র মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়ার বিচারের মাপকাঠি হিসাবে না দেখে একে যদি সমাজের একটি অংশ বলে গণ্য করা হয় তা হলে বিশ্লষণ গত ভাবে তা আরও বেশি উপযোগী হবে অবং নীতি সংক্রান্ত ক্ষেত্রেও বৃহত্তর পরিসর পাওয়া যাবে (পোলায়নি, ২০০১ : ৭৪, ১১৬, প্যারি, ২০০৯)।
আমরা যদি এই ধরনের একটি বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি তা হলে পরিচর্যামূলক কাজ এবং পারিশ্রমিকবিহীন গৃহস্থালির কাজকে কেন গুরুত্বপূর্ণ অপ্রথাগত কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন তা বোঝাটা সহজ হয়ে যাবে।
এই প্রসঙ্গে দু’টি প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, কেন বিনা পারিশ্রমিকের এই কাজগুলিকে অপ্রথাগত তকমা দেওয়া হবে? এবং দ্বিতীয়ত, এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে কেন ‘কাজ’ বলে স্বীকার করে হবে? হার্ট যখন অপ্রথাগত এই পরিভাষাটি সৃষ্টি করেছিলেন তখন এই ধরনের কর্মীদের কথা তাঁর মাথায় ছিল কি না তা অনুমান করা খুব শক্ত। তিনি অপ্রথাগত বলতে একটি বিশেষ আঙ্গিক বা গঠনের বিপরীত ধরনকে বুঝেছিলেন। সেই বিশেষ আঙ্গিক যদি অনুপস্থিত থাকে তবে কোন কাজকে অপ্রথাগত আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এই অর্থে, এমন যুক্তি দেওয়া যেতেই পারে যে পারিশ্রমিকবিহীন যে সমস্ত কাজের বর্তমানে কোনও স্বীকৃতি নেই সেগুলি অন্য শ্রেণির অপ্রথাগত কাজ।
বিনা পারিশ্রমিকের সমস্ত কাজকে অপ্রথাগত ধারণাটির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার যদি প্রয়োজন নেই, তবুও, তা করলে এই কাজের প্রতিও যে বিশেষ নীতিগত গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন তা বুঝতে সুবিধা হবে। তবে প্রথাগত কাজের ক্ষেত্রে যে ধরনের নীতিগত গুরুত্ব প্রয়োজন হয়, এ ক্ষেত্রে সেই ধরনের বা সমতুল্য গুরুত্ব না-ও হতে পারে।
পারিশ্রমিকবিহীন কাজকে যদি অপ্রথাগত শ্রেণিভুক্ত করাও হয় তবুও এই সমস্ত কাজের বিশেষ ধরনের কথা ভুললে চলবে না এবং সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অপ্রথাগত শ্রেণিটি শুধুমাত্র একটি সর্বব্যাপী ধারণা যার মধ্যে প্রথাগত নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোর বাইরে থাকা সামাজিক ভাবে মূল্যবান কাজগুলিকে একত্রিত করা যেতে পারে।
এ বারেই ঠিক পরের প্রশ্নটা চলে আসে—পারিশ্রমিকবিহীন কর্মকাণ্ডকে কেন ‘কাজ’ বলে স্বীকার করতে হবে? পরিচর্যামূলক কাজ বা গৃহস্থালির কাজের মতো বিনা পারিশ্রমিকের কাজ অবশ্যই সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখছে; একে প্রত্যক্ষ আর্থিক অবদান হিসাবে পরিমাপ করা যাবে না এবং তা করার প্রয়োজন নেই।
সমাজকে টিকিয়ে রাখতে এবং সমাজের ক্রমোন্নতিতে এই বিনা পারিশ্রমিকের কাজের অনেক অবদান রয়েছে। যদি সমাজের অন্তর্নিহিত অর্থই হয় একাত্মতা এবং সহমর্মিতা তা হলে বিনা পারিশ্রমিকের অবদানকারীরা যাতে স্বীকৃতি পান তা নিশ্চিত করা সমাজেরই দায়িত্ব। পারিশ্রমিকবিহীন কাজের এই স্বীকৃতি এই ভাবে সমাজ এবং সামাজিক অবদানকারীদের বোঝাপড়াভিত্তিক।
বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করা কর্মীরা সামাজিক ভাবে মূল্যবান যে অবদান রাখছেন তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমাদের রাষ্ট্রের একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। আলাইন সুপিয়ট এবং তাঁর সহকর্মীর প্রস্তাব মতো কর্মীরা যে বাধ্যতামূলক ভাবে এই ধরনের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন কাজের সেই বাধ্যতামূলক চরিত্রকেই স্বীকৃতি দানের অন্যতম ভিত্তি করা যেতে পারে (সুপিয়ট, ২০০১)।
সুপিয়ট এবং অন্যদের মতে, যদি কোনও কর্মকাণ্ড বাধ্যতামূলক দায়িত্বের অঙ্গ হিসাবে পালন করতে হয় তবে তাকে ‘কাজ’ এর স্বীকৃতি দিতে হবে। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃষ্টিভঙ্গি সমান ভাবে কার্যকর। তবে এই ধরনের কাজকে কী ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং এই ধরনের কাজে নিযুক্ত মানুষের স্বার্থ কী ভাবে রক্ষা করা হবে তা অবশ্য নীতি প্রণেতাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
অপ্রথাগত অর্থনৈতিক কাজকর্ম এবং অর্থনৈতিক নয় এমন অপ্রথাগত কাজকর্মকে আমরা স্বীকৃতি দিই বা না দিই, ‘কাজ’ হিসাবে এগুলি একটি মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ। আর তাই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও বটে। মতাদর্শগত ভাবে এই দুই শ্রেণির কাজই সামাজিক ভাবে মূল্যবান। তাই সমাজিক ভাবে উত্পাদনশীল বা অর্থনৈতিক ভাবে অবদানমূলক কাজের সঙ্গে সামাজিক ভাবে মূল্যবান কাজকে মিশিয়ে না ফেলার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। পারিশ্রমিকবিহীন অপ্রথাগত কাজের এই শ্রেণিটিকে স্বীকৃতিদানের মতাদর্শগত প্রশ্নটির মীমাংসা হলে বাস্তবে এই ধরনের কাজের স্বীকৃতিদানের কয়েকটি প্রস্তাবের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে।
এই প্রস্তাবগুলির মধ্যে রয়েছে পরিচর্যা ও গৃহস্থালির কাজের জন্য পারিশ্রমিকের দাবি থেকে শুরু করে অন্যান্য অর্থনৈতিক এবং কর্মসংস্থানের প্রশ্ন নির্বিশেষে সমস্ত পরিবারের আয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি। তবে এর পাল্টা যুক্তি হিসাবে বলা যায় শুধুমাত্র আর্থিক মজুরি বা পারিশ্রমিক মজুরিবিহীন অপ্রথাগত কাজকে স্বীকৃতিদানের ভিত্তি হতে পারে না। পারিশ্রমিক বা মজুরিবিহীন অপ্রথাগত কাজগুলিকে স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে বাস্তবে অর্থনৈতিক ছাড়া অন্য পন্থাও থাকতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের অপ্রথাগত কাজকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে এগোনোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতি সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার ধারণা তৈরি করার সময় কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। কর্মীদের নিজেদের অভিজ্ঞতা তাদের কাজের ধরন ও সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নীতি প্রণেতাদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে উঠতে পারে।
আবার অন্য দিকে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিশা দেখাতে পারে। অপ্রথাগত কর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ভালো ভাবে বুঝলে বিভিন্ন শ্রেণির অপ্রথাগত কর্মীদের স্বীকৃতি দান তথা তাদের কল্যাণ সাধনের নানান পন্থা বেরিয়ে আসবে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক নয় এমন পন্থাও রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ভাবে মূল্যবান (অপ্রথাগত) কাজের স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়নের নিম্নলিখিত পন্থাটিই হবে এ ব্যাপারে উপযুক্ত সূচনা।
মতাদর্শগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক রক্ষণশীলতা যদি অতিক্রম করা যায় তা হলে আমাদের নীতি প্রণেতাদের কাছে অন্যতম প্রধান কাজ হবে অপ্রথাগত কর্মীদের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে আনা। তাদের নিজস্ব নীতি নিয়ম চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অপ্রথাগত কর্মীদের অংশগ্রহণ করা উচিত। কর্মীদের সামাজিক আলোচনা প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। কাজের শ্রেণি এবং কর্মীরা যে কাজে নিযুক্ত তার ধরনের উপর নির্ভর করে এই সামাজিক আলোচনা প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা এমন ভাবে করতে হবে যাতে অংশগ্রহণের জন্য কর্মীদের কাছে সব চেয়ে বেশি এবং ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়।
সামাজিক আলোচনা প্রক্রিয়ায় অপ্রথাগত কর্মীদের যুক্ত করে আরও একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা প্রয়োজন। আমি আগেও আলোচনা করেছি যে, অপ্রথাগত কাজ ধারণাটি শুধুমাত্র একটি সামগ্রিক মতবাদ; বাস্তবে এর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মীরা এমন ধরনের কাজে নিযুক্ত যার সঙ্গে সেই প্রথাগত আঙ্গিক বা গঠনের কোনও মিল নেই, যে আঙ্গিকের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটি গড়ে উঠেছিল।
প্রতিটি বিশেষ শ্রেণির কাজ ও কর্মীদের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলি বোঝার জন্য প্রতিটি শ্রেণিকে একদম নতুন ও বিশেষ ঘটনা হিসাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। অপ্রথাগত কাজের বিচিত্র ধরনের ফলে নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। আমাদের সংবিধানের আইনি ক্ষমতার ভারসাম্যের যে বিধান আছে সেই অনুযায়ী আমাদের শাসনব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীভূত নীতি প্রণয়নের ধারণা (আইনি বা প্রশাসনিক) নতুন নয়।
এই নিবন্ধে, ‘অপ্রথাগত’ ধারণাটির বিশ্লেষণ করে আমি দেখিয়েছি যে, এই ধারণাটি সর্বব্যাপী বা সামগ্রিক অর্থে কার্যকর। বিভিন্ন শ্রেণির অপ্রথাগত কর্মীদের দুর্দশা লাঘব করার জন্য অপ্রথাগত এই সর্বব্যাপী তকমাটির ধোঁয়াশা কাটিয়ে কাজের প্রতিটি শ্রেণিকেই নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ গোষ্ঠীর অপ্রথাগত কর্মীদের যুক্ত করতে হবে যাতে কর্মীরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার খাতিরেই পরিচালন প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের সংবিধানের মহৎ আদর্শ ঠিক এই ধরনের পরিচালনব্যবস্থার কথাই বলে।
(লেখক কানাডার ‘ইউন্টার ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সেন্টার অন গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ওয়ার্ক’ – এ গবেষক।)
email: supriyonujs@gmail.com
সূত্র : যোজনা, অক্টোবর, ২০১৪।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/24/2020