তিন দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতার কাজ অর্থকরী বিচারে একটি অপাংক্তেয় পেশা হিসাবে গণ্য হত। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবাংলায় রাজ্যের শাসনক্ষমতায় বামফ্রন্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে। পেশা হিসাবে শিক্ষকতাকে বেছে নেওয়ার পিছনে অনেকেরই অনুপ্রেরণার উৎস ছিল একটা আদর্শ। অর্থ নয়, নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর পরিচয়ের মাধ্যমে সচেতন করে তোলা ছিল এই আদর্শের লক্ষ্য। অর্থের প্রয়োজন থাকলেও অর্থকে ঘিরেই জীবন ছিল না, জীবন ছিল আদর্শকেন্দ্রিক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠনেও এর প্রতিফলন ছিল। তাই নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে (১৯৩৫) শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি নয়, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নকে সংগঠনের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষকরা (তখন শিক্ষকদের একটি মাত্র সংগঠন ছিল)। বর্তমানে সমাজ–অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই পরিবর্তিত। কাজের আর্থিক প্রতিদান সব ক্ষেত্রেই একটা বড় বিবেচ্য। কিন্তু এর মধ্যেও একটা বিপরীত স্রোত দেখতে পাই বেশ কয়েক জন শিক্ষকের লেখায়। উত্তর দিনাজপুর জেলার সদ্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বপন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘প্রথম যখন আমি নিয়োগপত্র পেলাম সে দিন খুব ভালো লেগেছিল কারণ মনে মনে খুব আশা ছিল, অন্যান্য পেশার চেয়ে শিক্ষকতার কাজ পেলে করব। মনে পড়ে যায় ১৯৬৯ সালে দুই বন্ধু আলোচনা করে ঠিক করলাম রায়গঞ্জ শহর থেকে ৫ কিমি দূরে ফিরোজপুর গ্রামে একটি বিদ্যালয় তৈরি করব। সেই গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।’ সকলের মধ্যে শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়ার আগ্রহ এতটাই ছিল যে পেশা হিসাবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করার আগে থেকেই তিনি শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে চেয়েছিলেন। শিক্ষকতার পেশার প্রতি এই আগ্রহ শুধু আগের প্রজন্মের নয়, আমরা বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্যেও দেখতে পাই। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার শিক্ষক প্রসেনজিৎ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘আমি ১৯৯৯ সালে ... প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করি। পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের ... অধীন কর্মরত থাকেলও শিক্ষকতার পেশা আমাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করায়। যদিও পদোন্নতি ও উচ্চ বেতনের লোভকে আমায় এ সময় সংবরণ করতে হয়েছিল।’
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 8/27/2019