বৈষ্ণব আন্দোলনে ধর্মের প্রাধান্য থাকলেও চৈতন্যদেব মানবপ্রেমের ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি কোনও শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর তিরোধানের পর বেনারসের ষড়গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মনীতি ও আচরণবিধি প্রণয়ন করে একে নানা রূপ আনুষ্ঠানিকতা দান করেন। ফলে শাস্ত্রমুখী চিন্তার প্রভাবে চৈতন্যদেবের হৃদয়াশ্রিত প্রেমধর্মের গতিপ্রবাহ ক্রমশ রুদ্ধ ও শুষ্ক হয়ে পড়ে। এ দিকে উদারপন্থী বৈষ্ণবগণ শাস্ত্রের কঠোরতা অস্বীকার করেন এবং গুরু ও আখড়া অবলম্বন করে সহজিয়া মতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের অনুসারী নেড়ানেড়ির দল আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বাউল সম্প্রদায়ের পত্তন করে এবং গুরু বা মোহান্তগণ মিশনারির আদর্শ থেকে সরে গিয়ে মোহান্তগিরিকে উপার্জনের পন্থা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা গুরুদর্শন, দীক্ষাদান, মন্ত্রশিক্ষা, সাধনভজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষিণা ও ভেট প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা আরোপ করে একে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করেন।
চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই মানবতাবাদী বৈষ্ণবদের ধর্মচর্চা বর্ণবাদী ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়, কারণ বর্ণপ্রথার পরিপন্থী আচরণমালা তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। এর প্রেক্ষিতেই চলে আসে চৈতন্যদেবের মৃত্যু সংক্রান্ত রহস্যময়তা। কোনও কোনও মতে, রথযাত্রার সময় পায়ে ইট লেগে তাঁর মৃত্যু হয়। আবার কোনও কোনও মতে তিনি ‘জগন্নাথে লীন’ হয়ে গিয়েছিলেন। এই ‘জগন্নাথে লীন’ হওয়ার তত্ত্বটি কেউ কেউ এ ভাবে ব্যাখ্যা করেন যে কায়েমি স্বার্থ রক্ষায় তাঁকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হত্যা করেছিল। এ সম্পর্কে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও চৈতন্যের মৃত্যু মুহূর্তের স্পষ্ট চিহ্নের অভাব এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তৎকালীন বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রেক্ষিতে কিছু পারিপার্শ্বিক সূত্রের সাহায্যে কোনও কোনও গবেষক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
যাই হোক, কালের প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ্য সংস্কার প্রবল হলে উচ্চবর্ণের লোকেরা সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়ে বৈষ্ণবধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে নতুন মেধার আগমন বন্ধ হয়ে যায়। এ সব কারণে শতাব্দীকালের ব্যবধানে বৈষ্ণব আন্দোলনে ভাটা পড়ে এবং সতেরো শতক পর্যন্ত টিকে থাকলেও আঠারো শতকে সামাজিক শক্তি হিসেবে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, amadernangalkot.com,thesundayindian.com
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/28/2020