ভয় ভাঙা ভোর।’ আয়াতুল্লা খোমেইনির রক্তচক্ষুর নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে এই নামেই এক বিশ্ব নাট্য দিবসে ইরানের প্রান্তিক গ্রামে নাটক করেছিল গোপনে জড়ো হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।’ ৮০-র দশকের অন্তবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে তৈরি হয়েছিল অন্য ইতিহাস। ২৭ মার্চের আগে থেকেই ছেলেমেয়েরা অকুতোভয়ে ঘোষণা করেছিল --- আমাদের প্রতি দিনই বিশ্ব নাট্য দিবস। এরশাদ-জমানার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-র ছোট বড় ঘরগুলোতে তখন নাট্য-দুর্গের তরুণ সৈনিকদের উজ্জীবিত মহড়া। সে বার ২৭ মার্চের আগে-পরে এরশাদ-বিরোধী যত সংখ্যক প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল, তা গিনেস বুকে ওঠার মতো।
ক’ বছর আগে বিশ্ব নাট্য দিবসের আগে বাগদাদের বিধ্বস্ত এক বাড়ি থেকে এক গৃহবধূ একটি ব্লগ লিখতে পেরেছিলেন অকুতোভয়ে। তাঁর বাড়ির সঙ্গে বাগদাদের আধুনিক নাট্যচর্চার সম্পর্ক ছিল। ২৭ মার্চের আগে ব্লগ-এ লেখা সেই আত্মজৈবনিক কথন নিয়ে একাধিক নাটক তৈরি হয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার বিখ্যাত নির্দেশক ও শিক্ষক কীর্তি জৈন ২০০৯-এ কলকাতায় এসেছিলেন, দুনিয়া জুড়ে আলোড়ন তোলা ওই ‘বাগদাদ বার্নিং’ নাটকটি নিয়ে। মিনার্ভা থিয়েটারে সে নাটকের যাঁরা দর্শক ছিলেন তাঁরা ওই অনন্য প্রযোজনার পাশাপাশি আক্রান্ত রক্তাক্ত বাগদাদের এক ছাপোষা গৃহবধূর দুর্জয় সাহস আর নির্ভয় অভিজ্ঞতা-লিখনের তারিফ করছিলেন। এ বছর খোদ ইরাকেই বন্ধ থিয়েটারের দরজা খুলে যে নাটকগুলো মঞ্চায়নের প্রস্তুতি চলছে বিশ্ব নাট্য দিবসকে সামনে রেখে, তার মধ্যে ‘বাগদাদ বার্নিং’ আছে।
আফ্রিকার জাম্বিয়ায় মেয়েরা যখন বিয়ের পর স্বামীদের অবাধ যৌনাচার আর প্রাত্যহিক শরীরী অত্যাচারকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নিচ্ছিল, তখন জাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিদ চিলা এফকে চিলালা তাঁরা অনুগত তরুণ নাট্যজনদের বিশ্ব নাট্য দিবসে উদ্বুদ্ধ করলেন, ‘জাম্বিয়া জুড়ে হেনরিক ইবসেন-এর ‘ডল্স হাউস’কে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে মঞ্চস্থ কর। বিয়ে হয়ে যাওয়া, বোবা কান্নায় গুমরে ওঠা, মার খাওয়া মেয়েদের সংস্কারগুলোকে অন্য কোনও ভাবে ধাক্কা দিতে পারবে না।’ জাম্বিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিলালার অনুসরণকারীরা সফল ভাবেই বিশ্ব নাট্য দিবসে সংস্কারাচ্ছন্ন মেয়েদের অনেককেই নিজস্ব নাট্যপ্রযোজনার মধ্য দিয়ে দিন বদলানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
আবার এর ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতা, উত্তর নাইজেরিয়ার গ্বকো শহরের নাট্যকর্মীদের। শহরের লাগোয়া গ্রামগুলোতে ঘর আছে ঘরনি নেই, ঘরনিরা গ্বকো শহরের সিমেন্ট কারখানায় আর নানা রকম ছোট বড় ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়ে গিয়ে শহুরে কর্মচারী ও অফিসারদের টাকাপয়সায় আর ভালোবাসায় আটকে পড়েছে। এমন সুখ ছেড়ে তারা আর গাঁয়ে ফেরার কথা ভাবছেই না। ঘরে ফিরলেই তো মারধর খাওয়া আর চার হাতের ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে চোদ্দোটা শরীরের শীত মোকাবিলার পণ্ডশ্রম! আহমাদু বেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রস কিড তাঁর ‘ফ্রম আউটসাইড ইন টু ইনসাইড আউট’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, এক বিশ্ব নাট্য দিবসে নাট্যকর্মীদের নিয়ে প্রায় ঘরনিশূন্য গ্রামে গিয়ে এই সমস্যাকে সামনে রেখে নতুন নতুন নাটক পরিবেশন শুরু করা হল। নাটকগুলি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল, যদিও রস কিড জানাননি, অনুতপ্ত স্বামীদের কষ্ট বুঝতে পেরে তাদের স্ত্রীরা ঘরে ফিরে এসেছিল কি না। এমনই নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতা উঠে আসছে বিশ্ব নাট্য দিবস পালনের মঞ্চগুলিতে।
সূত্র: এই সময়, ২৭ মার্চ, ২০১৫
ছবি : এই সময়
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/15/2020