অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

আন্তজাতিক ডাল শস্য বর্ষ ও একজন মহিলা বিজ্ঞানী

২০১৩ সালেই জাতিসঙ্ঘ ঘোষণা করেছিল ২০১৬ সাল হবে আন্তর্জাতিক ডালশস্য বর্ষ। সেই হিসেবে সারা বিশ্বের সাথে সাথে এই দেশ জুড়েও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ডালশস্য বর্ষ। উদ্দেশ্য হল ডালের পুষ্টিগুণ, প্রোটিন মাত্রা প্রভৃতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা, চাষীদের ডাল চাষে উৎসাহ দান ইত্যাদি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানী কমলা সোহনী তাঁর গবেষক জীবন শুরু করেছিলেন এই ডাল শস্যের প্রোটিন-এর মাত্রা নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে।

ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক গবেষণা কখনোই হয় নি। তার উপর গবেষক যদি মহিলা হন তবে তো আর কথাই নেই। সারা পৃথিবীতে আবহমান কাল থেকেই এই লিঙ্গ বৈষম্য চলে আসছে, আর বিজ্ঞানের জগতে তো এর নগ্ন রূপ খুবই প্রকট। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন ভারত সবে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা জগতে প্রবেশ করতে চলেছে সেই সময় এই লিঙ্গ বৈষম্য ভীষণ ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। সমাজ সংস্কারকরা নারী শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও আমাদের জাতীয় নেতাদের অনেকেই নারীর বিজ্ঞান শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। স্বয়ং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীই এর অন্যতম উদাহরণ। গান্ধীজীর ভাষায়– “প্রকৃতি নারী আর পুরুষ এই দুই পৃথক সত্ত্বার সৃষ্টি করেছে; শিক্ষার জগতেও এই পার্থক্য বজায় থাকা উচিৎ। একথা সত্য যে জীবনের দিক থেকে পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান কিন্তু তাদের কাজের জগৎ আলাদা। নারী ঘরের সর্বময় কর্ত্রী আর পুরুষ বাইরের জগতের কর্তা। পুরুষ সংসারের উপার্জনকারী আর নারী তা খরচ করবে, সঞ্চয় করবে -প্রকৃতি আমাদের এই শিক্ষাই দেয় আর আমাদের উচিৎ তা মেনে চলা। নারী কখনোই তার জীবিকা সংস্থানের জন্য ঘরের বাইরে যাবে না”।

স্বয়ং জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী নারীর শিক্ষার বিরোধী ছিলেন।

সামাজিক অবস্থা যখন এরকম তখন নারীর উচ্চশিক্ষা, তাও আবার বিজ্ঞানের জগতে, ভাবাটাই বোধহয় ছিল দুরূহ। এই প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও যে কয়েকজন মহিলা বিজ্ঞানের জগতে অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন তাঁদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেকেই আজও জানেন না। এটা আমাদের পক্ষে বড়ই লজ্জার। এরকম অবস্থায় আত্মীয় স্বজন সমাজ সবার সাথে লড়াই করে বিজ্ঞানের মত দুরূহ বিষয়ে সাফল্য পেতে কী নিষ্ঠাই না তাঁরা দেখিয়েছেন সেইসময়, আজকের যুগে বসে তা ভাবতেও অবাক লাগে। কমলা সোহনী তার এক অন্যতম উদাহরণ। নারী হওয়ার দরুন কী তীব্র লড়াই এর মধ্য দিয়ে তার সাফল্য এসেছিল তা জানলে আধুনিক যুগের মেয়েরা হয়তো বা আরও উজ্জীবিত হবে। শুধু মাত্র নারী হবার অপরাধে তাকে যেসব অবস্থা বা ব্যক্তির সাথে লড়াই করতে হয়েছে তা আমাদের কল্পনারও অতীত ।

কমলার জন্ম ১৯১২ সালে। কমলা ছিলেন তখনকার মুম্বাই প্রদেশের অন্তর্গত বরোদা শহরের এক বিখ্যাত ও উচ্চশিক্ষিত বংশের মেয়ে। তাঁর বাবা নারায়ণ রাও ভাগবত ও কাকা মাধব রাও ভাগবত দুজনেই মুম্বাইয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন। তাঁরা চাইতেন তাঁদের আদরের মেয়েটি যেন ভবিষ্যতে মাদাম কুরির মত একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী হয় ও দেশের মুখ উজ্জল করে। তাই কমলাকে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তুলতে তার পরিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। কমলা নিজেও একজন বড় বিজ্ঞানী হতে গেলে যেভাবে তৈরী হতে হয়, যেসব গুণ অর্জন করতে হয় তার প্রতিটি গুণ কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিলেন। পড়াশুনাতে ছিলেন অসম্ভব মনোযোগী। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই সময়ে রসায়নে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশুনো সম্পন্ন করেছিলেন।  ঠিক সেই সময় নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী স্যার সি ভি রামন ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এর নির্দেশক। যেখানে আধুনিক গবেষণার সমস্ত সুযোগসুবিধা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সব বিজ্ঞানী ও ভাবী বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ব্যাঙ্গালোরের এই প্রতিষ্ঠান। কমলাও তার ব্যাতিক্রম নন। যেহেতু তিনি মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নাম্বার এর অধিকারিণী ছিলেন, তাই তাঁর মনে দৃঢ় প্রত্যয় ছিলো যে তিনি অধ্যাপক রামন এর কাছে গবেষণা করার সুযোগ পাচ্ছেনই।

এই মনোভাব সাথে করেই তিনি বাবা ও কাকার সাথে ব্যাঙ্গালোর রওনা হলেন। কমলা ভাবতেই পারেননি সেই যুগের সমাজ নারীর জন্যে কত কঠোর, কারণ এতদিন তিনি ছিলেন বাবা মার ছত্রছায়ায়। এবার তাঁর নারী জীবনের প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হল। তিনি জানতে পারলেন তিনি নারী, এই অপরাধে তিনি রামন এর গবেষণা কেন্দ্রে ভর্তির অনুপযুক্ত। তাঁর বাবা কাকার শত অনুরোধ, যুক্তি রামন এক কথায় খারিজ করে দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন যে তিনি এক কথার মানুষ এবং একটি মেয়েকে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করবেন না।

নারী হওয়ার অপরাধে তিনি রামন এর গবেষণা কেন্দ্রে ভর্তির অনুপযুক্ত বলে সাব্যস্ত হলেন।

কিন্তু কমলা আর পাঁচজনের মতো নন, তিনি অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। তাই তিনি রামনের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। ভর্তি না করার যুক্তিপূর্ণ কারণ জানতে চেয়ে সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। প্রথমদিন অগ্রাহ্য করলেও রামনকে হার মানতে হোলো কমলার জেদের কাছে। এটা হয়তো কমলার নৈতিক জয়। কিন্তু যে সব শর্ত সেদিন রামন কমলার উপর আরোপ করেছিলেন তা ভাবলে আজও সবার মনে প্রশ্ন জাগে রামনের মতো একজন নোবেল বিজয়ীর কাছে সে যুগের নারী জাতির যদি এই মূল্যায়ন হয় তবে সাধারণ মানুষের কাছে, সমাজের কাছে তারা কতটুকুই বা সহযোগিতা আশা করতে পারে? কমলাকে যে শর্তগুলো রামন দিয়েছিলেন সেগুলো হল:

  1. তিনি কখনোই নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে বিবেচিত হবেন না।
  2. ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময়সীমা তাঁর নির্দেশক (গাইড) এর উপর নির্ভর করবে।
  3. ল্যাবরেটরির পরিবেশ তিনি বজায় রাখার চেষ্টা করবেন।
  4. এক বছর কমলার কাজ দেখার পর তিনি কমলা সম্পর্কে ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত নেবেন।

এই কারণেই হয়তো কমলা কোনদিনই অধ্যাপক রামনকে ক্ষমা করতে পারেন নি। তাই আমরা দেখতে পাই ১৯৯৭ সালে মুম্বাই এর ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার এ ইন্ডিয়ান উইমেন সায়েন্টিস্টস অ্যাসোশিয়েশন আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় রামন সম্পর্কে কমলার তীব্র বিদ্বেষ ভাব। এই সভায় কমলা বলেছিলেন:

ভর্তির শর্ত হিসেবে যে প্রস্তাব গুলো অধ্যাপক রামন সেদিন রেখেছিলেন তার কোনটাই যে কমলা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি তা আমরা বুঝতে পারি যখন কমলার মুখ থেকে শুনি:

অর্থাত্‍ খানিকটা বাধ্য হয়েই কমলা শর্ত গুলো মেনে নিয়েছিলেন। একজন ছাত্রী গবেষকের মনে এটা কতখানি আঘাতের হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। শুধুমাত্র নারী হবার অপরাধে এমন শাস্তির কথা ভাবাই যায় না। যাই হোক তিনি ভাগ্যবতী কারণ এখানে শ্রীনিবাসন এর মত একজন উদার মনের শিক্ষক তিনি পেয়েছিলেন। তিনি পড়াশুনার ব্যাপারে যতটাই কঠোর ছিলেন শিক্ষক হিসাবে ছিলেন ততটাই উদার। মূলত তাঁরই উদ্যোগে এক বছরের মাথায় রামন কমলার কাজকর্মে খুশি হয়ে তাঁকে নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে মেনে নিলেন, এবং শুধু তাই নয়, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এর দরজা মেয়েদের জন্যে খুলে দিলেন। নারী শিক্ষার জগতে এ যে কত বড় সাফল্য, কত বড় বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তারই প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তীকালে কমলা বলেন:

এরপর আরও যে তিন মহিলা রামনের গবেষণাগারে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন তারা হলেন – আন্না মানি, ললিতা চন্দ্রশেখর ও কে সুনন্দাবাঈ। এঁরাও ভীষণভাবে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, তবে সে এক অন্য ইতিহাস।

শ্রীনিবাসনের উত্‍সাহে তিনি বিভিন্ন প্রোটিন নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। তার প্রথম কাজটি ছিল “ডালের প্রোটিন” নিয়ে। এটি ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসের কারেন্ট সায়েন্স পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। তিনি পরীক্ষা করে দেখান যে ডালের মধ্যে প্রোটিন নয় এমন নাইট্রোজেনের পরিমাণ যথেষ্ট যা মানবদেহ সহজেই নিতে পারে। আজ যখন আন্তর্জাতিক ডালবর্ষে আমরা এই তথ্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছি তখন আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে একজন গ্র্যাজুয়েট স্তরের ছাত্রী এ নিয়ে গবেষণা করছেন ও ভাবছেন, এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় না কি যে তিনি সমসাময়িক কালের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন?

কমলার পরের গবেষণার বিষয় ছিল দুধের প্রোটিন। এটিও কারেন্ট সায়েন্স পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। শ্রীনিবাসন যে শুধুমাত্র তাকে গবেষণার কাজেই সাহায্য করতেন তা নয়, রীতিমত তখনকার যুগের নামী জীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে চিঠি মারফত কিভাবে যোগাযোগ রাখতে হয় তাও শেখাতেন। ফলে কমলা অল্প দিনের মধ্যেই আধুনিক গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলেন। কমলার প্রোটিন সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণার জন্যে মুম্বাই ইউনিভার্সিটি তাঁকে এম এস সি ডিগ্রী প্রদান করল। তার চাইতেও বড় সাফল্য এল যখন তিনি কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করার সুযোগ পেলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি স্প্রিঙ্গার (SPRINGER) স্কলারশিপ ও মুম্বাই ইউনিভার্সিটির স্যার মঙ্গলদাস নথুভাই স্কলারশিপ পান। প্রথমটি কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাঁর পড়াশুনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় আর দ্বিতীয়টির সাহায্যে তিনি আমেরিকা উইমেন সায়েন্টিস্ট মিটিং এ যোগ দিতে পারেন। মুম্বাই ইউনিভার্সিটির উপর কমলার কৃতজ্ঞতা ছিল বিশাল। তাই যখন তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে ডেরেক রিখটার এর সাথে তাঁর গবেষণা পত্র প্রকাশ করলেন তার পাদটীকাতে উল্লেখ করলেন।

কমলার গবেষণা জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় বোধ হয় তাঁর কেম্ব্রিজ এর তিন বত্‍সরের কাছাকাছি সময়কাল। যদিও তাঁর গবেষণার হাতেখড়ি হয়েছিল শ্রীনিবাসন এর হাত ধরে, তবুও তিনি বায়োকেমিস্ট্রির প্রকৃত গবেষণাগার কেম্ব্রিজ এ গিয়েই পান। প্রথমেই কিন্তু তিনি কেম্ব্রিজ এ পড়ার সুযোগ পান নি। একজনের শূন্য স্থানে তিনি ভর্তি হবার সুযোগ পান। কিন্তূ তাঁর সৌভাগ্য এই যে তিনি নোবেল বিজয়ী প্রোফেসর ফ্রেডেরিক হপকিন্স-এর অধীনে কাজ করার সুযোগ পান।

কেম্ব্রিজ-এ তিনি ডক্টর ডেরেক রিখটার এর কাছে কাজ করতেন। ডেরেক যে টেবিলে রাতে নিজে কাজ করতেন দিনের বেলায় সেটি কমলার জন্যে ছেড়ে দিতেন। যখন ডেরেক কোনও কাজের জন্যে বাইরে যেতেন তখন কমলা দিন রাত সেই টেবিলে কাজ করার সুযোগ পেতেন। এই সময় তাঁর কাজে সহায়তা করতেন ডক্টর রবিন হিল। দুজনের কাজের ধরণ ছিল এক। কেবল ডক্টর হিল গাছের কলাতন্ত্রের উপর কাজ করতেন আর কমলার কাজ ছিল আলুর উপর। দুজনেই জারণ প্রক্তিয়াতে এনজাইম এর ভূমিকা কি তা জানবার চেষ্টা করছিলেন। কমলা দেখতে পান উদ্ভিদের প্রতিটি কোষে “সাইটোক্রোম-সি” নামক এক এনজাইম এর উপস্থিতি; যারা কোষের জারণ কাজে এক প্রধান ভূমিকা পালন করে। এই আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে আশীর্বাদ স্বরূপ।

যাই হোক, একদিন একটু বেশী রাতে একজন বিদেশিনী গবেষককে ডেরেক এর টেবিলে গবেষণা করতে দেখে হপকিন্স কৌতুহলবশে তাঁর কাছে আসেন। তিনি জানতে পারেন ডেরেক এর অনুপস্থিতিতে কমলা অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করবার সুযোগ পান। তিনি কমলা কোন বিষয় এর উপর কি কাজ করছেন তা জানতে চান। কমলার কাছে “ সাইক্রোটোম-সি” এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি অভিভূত হন। কাজটি যে একান্তই মৌলিক এ কথা জানিয়ে কমলাকে তিনি গবেষণা পত্র জমা দিতে বলেন। অগত্যা কমলা তাঁর নিজের হাতে টাইপ করা মাত্র ৪০ (চল্লিশ) পৃষ্ঠার একটি গবেষণা পত্র জমা দেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এই মৌলিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পি এইচ ডি ডিগ্রীতে ভূষিত করে।

ডিগ্রী পাবার পর কমলা ফিরে এলেন ভারতে। যোগদান করলেন লেডী হার্ডিঞ্জ কলেজে। সেখানে তখন সদ্য বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ তৈরি হয়েছে। তার প্রধান হিসেবে যোগদান করলেন সেখানে। সেটা ছিল ১৯৩৯ সাল। কিন্তু গবেষণার সুযোগ অপ্রতুল হওয়ার কারণে তিনি এখানকার কাজ ছেড়ে যোগদান করলেন কূনূর এর নিউট্রিশন রিসার্চ ল্যবরেটরিতে। এখানে তিনি সরাসরি সহ অধিকর্তার পদে যোগ দেন। ভিটামিন এর উপর নানান রকম গবেষণার কাজ শুরু করেন। দেশ বিদেশ এর বিভিন্ন জার্নাল এ তাঁর এই গবেষণা পত্রগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। ঠিক এই সময় তাঁর কাছে এম ভি সোহনীর সাথে বিবাহের প্রস্তাব আসে। তিনি এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ১৯৪৭ সালে পুরোপুরি ভাবে মুম্বই চলে যান।

ঠিক সেই সময় মহারাষ্ট্র সরকার, রয়াল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স (বর্তমানে এটি ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স নামে পরিচিত)-এ বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ খুলেছেন। এই বিভাগ চালানোর জন্যে উপযুক্ত প্রোফেসরের খোঁজ চলছে। কমলা সেই পদের জন্যে আবেদন জানালেন এবং বলাই বাহুল্য যে তিনি ওই পদের জন্যে মনোনীতও হলেন। এখানে এসে কমলার জীবনের এক নূতন অধ্যায় শুরু হল।

কমলা লক্ষ্য করেন যেসব আদিবাসী মেয়েরা নীরা পান করেন বিশেষত তারাই কৈশোর অবস্থায় বা গর্ভধারনের সময় অপুষ্টি সংক্রান্ত রোগে কম ভোগেন।

গবেষক থেকে তিনি হলেন একজন আদর্শ শিক্ষিকা। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পুষ্টির উপর গবেষণা শুরু করলেন। সেই সময় যা ছিল দেশের পক্ষে খুবই জরুরী। কমলা ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ডাল, ধান, আটা প্রভৃতির পুষ্টিগুণ নিয়ে নানান উল্লেখযোগ্য কাজ করতে থাকেন। তাঁদের কাজের উদ্দেশ্যে যে শুধুমাত্র গবেষণা করা তা ছিল না। দেশের প্রয়োজন অনুসারে গবেষণা করার জন্য ছাত্র ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার মত আদর্শ শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। এই সময় তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হল নীরার উপর কাজ। নীরা হল খেজুর গাছ থেকে তৈরি রস। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ স্বয়ং তাঁকে এই কাজের জন্য উত্‍সাহ যোগান। কমলা লক্ষ্য করেন যেসব আদিবাসী মেয়েরা নীরা পান করেন বিশেষত তারাই কৈশোর অবস্থায় বা গর্ভধারনের সময় অপুষ্টি সংক্রান্ত রোগে কম ভোগেন। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে নীরার মধ্যে ভিটামিন সি সহ অন্যান্য ভিটামিনগুলি বহুদিন পর্যন্ত কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সক্ষম। কমলা ও তাঁর ছাত্র ছাত্রীরা দীর্ঘ বারো বছর ধরে নীরার উপর কাজ করে এসেছেন। অবশেষে এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়। তিনি দুধের প্রোটিন নিয়েও নানা কাজ করেন। ছাত্র ছাত্রী গড়ার পাশাপাশি তিনি তাঁদের বিভিন্ন রিসার্চ জার্নালে লেখা পাঠাতেও উত্‍সাহিত করতেন। অবশেষে কর্মজীবনের শেষ চার বছর তিনি ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এর নির্দেশক হন।

১৯৬৬ সালে কমলা সহ নয়জন মহিলা প্রথম Consumer Guidance Society of India বা সংক্ষেপে সি জি এস আই নামক সংস্থা স্থাপন করেন। ক্রেতা সুরক্ষার মতন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেই সময় থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন। এক কথায় তাঁর এই চিন্তা ভাবনা ছিল তৎকালীন সময়ের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। এই সংস্থাটির কাজ ছিল ভেজাল নিয়ে গবেষণা করা। দোকানদারদের সঠিকমানের ওজন ব্যবহার করতে বাধ্য করা। তাছাড়া কমলা নিজে ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখতেন সাধারণ মানুষকে অবহিত করার জন্য। ছোটদের মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান শিক্ষা দেবার জন্যে তিনি মারাঠি ভাষায় কতকগুলি বইও রচনা করেছেন। সি জি এস আই এর তরফ থেকে তিনি নিয়মিত “কিমত” নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ে নানা পরামর্শ থাকতো এই পত্রিকাটিতে। কমলার জীবন ছিল বর্ণবহুল, তিনি সর্বদাই নিজেকে সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োজিত রাখতেন।

কমলা সারাজীবন নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে কাজ করে গেছেন। গবেষক, শিক্ষিকা, সমাজসেবী, লেখিকা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নারী হয়েও সমস্ত বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ এর মহানির্দেশক ডক্টর জি ভি সত্যবতী তাঁকে সম্মান জানানোর জন্যে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান চলাকালীন মঞ্চেই কমলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কোমাতে চলে যান।

এ বছর ডালশস্য বর্ষ নিয়ে হয়তো অনেক অনুষ্ঠান হবে, কিন্তু সেইসব অনুষ্ঠানে এমন এক মহীয়সী, যিনি সে যুগে বসে এতসব বাধা বিপত্তিকে তুচ্ছ করে ডালশস্য নিয়ে জনসাধারণের কথা ভেবে কাজ করে গেছেন, তাঁর কথা বেমালুম ভুলে গেলে চলবে না। তাই ডালশস্যের বছরে তাঁর প্রতি রইলো আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা।

লেখক পরিচিতি: শ্রী ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় শিলিগুড়ির নর্থ বেঙ্গল সাইন্স সেন্টারে এডুকেশন অফিসার। লেখাটির কিছু অংশ Arvind Gupta: Bright Sparks, Inspiring Indian scientists from the past থেকে ভাবানূদিত।

উৎস: http://bigyan.org.in/2016/08/23/kamala-sohonie/

সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/28/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate