(এটিকে সাধারণ দিকনির্দেশিকা হিসাবে ধরা যেতে পারে। কোনও ভাবেই এখানে উল্লিখিত মতামতকে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শের বিকল্প হিসাবে ধরা যাবে না।)
প্রফেসর শুভঙ্কর চৌধুরি
বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রিনোলজি
আইপিজিএমইআর এবং এসএসকেএম হাসপাতাল, কলকাতা
প্রশ্ন ১ : শোনা যাচ্ছে ডায়াবেটিস বা মধুমেহ নাকি ভারতে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এটা কি সত্য?
উত্তর : দুর্ভাগ্যবশত, উত্তরটা হল হ্যাঁ। আজ আমাদের বয়স্কব্যক্তিদের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এই রোগের শিকার। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি পঞ্চম ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মানুষ হলেন এক জন ভারতীয়। একটি দেশে সর্বাধিক ডায়াবেটিস আক্রান্তের নিরিখে আমাদের অবস্থান চীনের ঠিক পরেই। এর থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশে দশ কোটিরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবেন।
প্রশ্ন ২ : ডায়াবেটিসের এত বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে কেন? এর কারণ কি আমাদের দেশে মিষ্টির দোকানের আধিক্য?
উত্তর : ভারতীয়রা জিনগত ভাবে বেশি ডায়াবেটিস প্রবণ। তবে বর্তমানে যে ডায়াবেটিসের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এর কারণ শারীরিক কসরতের অভাব এবং অধিক ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা। এর ফলে আমাদের সমাজে মোটা হওয়ার প্রবণতা খুব বেড়ে যাচ্ছে। তবে মোটা নন এমন মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এঁদের বেশির ভাগেরই তলপেটে চর্বি জমে ভুঁড়ির আকৃতি নেয়। মানসিক স্ট্রেস বা চাপও ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।
বর্তমান প্রজন্মের ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। ফলে সব ধরনের ফাস্ট ফুডের দোকানও সংখ্যায় বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র মিষ্টির দোকানকে এ ব্যাপারে দায়ী করলে চলবে না। এই ধরনের ফাস্ট ফুডের বাড়বাড়ন্তও ডায়াবেটিসের জন্য অংশত দায়ী।
প্রশ্ন ৩ : আমার ডায়াবেটিস আছে। শুনেছি এই রোগ বিকল্প চিকিৎসার মাধ্যমে সেরে যায়। আমি কি সে দিকে চেষ্টা করে দেখতে পারি?
উত্তর : সত্যি কথা বলতে কি ডায়াবেটিস ভালো করে দেওয়ার কোনও চিকিৎসা এখনও নেই। তবে মানব জেনোম প্রকল্পের অগ্রগতির দরুন সুদূর ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ভালো করে দেওয়ার চিকিৎসা শুরু হলেও হতে পারে। তবে অদূর ভবিষ্যতে তার কোনও সম্ভাবনা নেই।
তবে ডায়াবেটিসকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আক্রান্ত মানুষজন প্রায় সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন।
ফলে প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করাই শ্রেয়। ভালো হয়ে যাওয়ার দুরাশায় অন্য কিছু চেষ্টা করে অর্থ ও সময় নষ্ট করে কোনও লাভ নেই।
প্রশ্ন ৪ : আমার ডায়াবেটিস রয়েছে। আমার বংশধরও কি এই রোগে আক্রান্ত হবে?
উত্তর : সবচেয়ে প্রচলিত হল টাইপ-২ ডায়াবেটিস (আগে এটা ‘ম্যাচিওরিটি অনসেট ডায়াবেটিস’ বা ইনসুলিন লাগে না এমন ডায়াবেটিস নামে পরিচিত ছিল)। এই ডায়াবেটিসের উপর জিনের প্রভাব অত্যন্ত জোরালো। ফলে আপনার ডায়াবেটিস থাকলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হবে ৪০ শতাংশ।আপনার স্ত্রী/স্বামীরও ডায়াবেটিস থাকলে এই সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়াবে ৯০ শতাংশে। তবে মনে রাখতে হবে ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।
প্রশ্ন ৫ : এমন কোনও উপায় রয়েছে যার মাধ্যমে আমার ছেলে বা মেয়ের পক্ষে ডায়াবেটিস এড়ানো সম্ভব হয়?
উত্তর : ভাল খবর হল যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। আপনার ছেলেমেয়ে স্বাস্থ্যসচেতন জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সম্ভাবনা অন্তত ৫০ শতাংশ কমাতে পারবে। তার মানে তাদের ভাজা ও স্নেহ পদার্থযুক্ত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। খাদ্যতালিকায় তাজা ফল ও সবজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। (যেমন জোরে হাঁটা, সাইকেল চালানো বা জগিং করা। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৈনিক ৩০ মিনিট জগিং করলেও চলবে। ছোটবেলায় এদের শারীরিক কসরৎ হয় এমন খেলাধূলায় আকৃষ্ট করতে হবে এবং কম্পিউটার গেমসের মতো ঘরে বসে খেলায় যথাসম্ভব অনুৎসাহিত করতে হবে)। দেখতে হবে তারা যাতে স্বাভাবিক শারীরিক ওজনের হয়, চর্বিযুক্ত পেটের অধিকারী যেন না হয়।
প্রশ্ন ৬ : আমার চিকিৎসক বলছেন রুটিন রক্ত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। কিন্তু আমি শারীরিক দিক দিয়ে কোনও অসুবিধা বোধ করছি না। এখন আমি কী করব?
উত্তর : আপনাকে ফের প্লাজমা গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হবে। হয় আট থেকে দশ ঘণ্টা উপোসে থাকার পর অথবা ৭৫ মিলিগ্রাম গ্লুকোজ নেওয়ার ২ ঘণ্টা বাদে পরীক্ষা করতে হবে। এই পরীক্ষার ফলাফল যদি বিশেষ ভাবে অস্বাভাবিক হয় তা হলে বুঝতে হবে আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে। বর্তমানে ডায়াবেটিস নির্ণয়ের যে মান ধরা হয় তা হল, খালি পেটে পরীক্ষায় প্লাজমা গ্লুকোজের পরিমাণ ১২৬ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের সমান বা তার চেয়ে বেশি। এবং খাবারের মাধ্যমে গ্লুকোজ নেওয়ার দু’ঘণ্টা পর পরীক্ষা করলে তা যদি ২০০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটারের বেশি বা তার সমান হয়। এ ক্ষেত্রে কোনও লক্ষ্মণ ধরা না পড়লেও আপনাকে চিকিৎসা করাতে হবে। (একেবারে শুরুতে জীবনযাত্রার ধরন পাল্টানোর দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। একদম গোড়াতেই ওষুধ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।)
প্রশ্ন ৭ : লক্ষ্মণ ধরা না পড়লে চিকিৎসা করানোটা অযৌক্তিক বলে মনে হয়। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন কেন?
উত্তর : ডায়াবেটিসকে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ বলা হয়। এই রোগ নিঃশব্দে আপনার দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত যখন লক্ষ্মণ দেখা দিল তখন চিকিৎসা শুরু করাটা হয়তো দেরি হয়ে যাবে। ডায়াবেটিস হৃদরোগ ও সেরিব্রাল স্ট্রোকের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২-৩ গুণ বাড়িয়ে দেয়। ডায়াবেটিসের কারণে অনেক সময় পা কেটে বাদ দিতে হতে পারে। পূণর্বয়স্কদের অন্ধত্বের অন্যতম কারণই হল ডায়াবেটিস। এই রোগ কিডনির ক্ষতি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কিডনির অকার্যকারিতা,বয়স্ক মানুষদের ডায়ালিসিস করা ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের অন্যতম কারণই হল ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের গাফিলতি এই ধরনের জীবনহানিকর স্থায়ী জটিলতার পাশাপাশি অন্য জীবননাশক জটিলতার জন্ম দিতে পারে যেমন ডায়াবেটিক কিটোসাইডোসিস (diabetic ketoacidosis)। বিভিন্ন ধরনের জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। ঠিক সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে এবং তা নিয়মিত ভাবে চালিয়ে গেলে এই ধরনের বেশির ভাগ জটিলতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
প্রশ্ন ৮ : আমার চিকিৎসক আমাকে ধূমপান করতে নিষেধ করেছেন। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে এর কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
উত্তর : ধূমপায়ীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সাধারণদের তুলনায় বেশি থাকে। ধূমপান বন্ধ করে দিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণেও কিছুটা সুবিধা হয়।
তবে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ধূমপান বন্ধ করতে বলা হয় তার প্রধান কারণ হল, তামাক(যে কোনও ধরনের তামাকের ব্যবহার) ডায়াবেটিস জনিত অন্যান্য জটিলতা যেমন, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি ও চোখের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
প্রশ্ন ৯ : আমার বাবার ডায়াবেটিস ছিল। কিন্তু সব সময় তিনি রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। তা সত্ত্বেও তিনি খুব কম বয়সে মারা গিয়েছেন। তা হলে আপনি কী করে বলছেন যে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা জটিলতাকে প্রতিরোধ করতে পারে?
উত্তর : ডায়াবেটিস ধরা পড়ে রক্তে উচ্চ পরিমাণ শর্করা থাকলে। কিন্তু ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ব্যক্তির এমন কিছু জটিলতা থাকতে পারে যা হৃদরোগ, স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে মাত্রাতিরিক্ত স্নেহজাতীয় পদার্থের উপস্থিতি।(যেমন ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’কোলোস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড) সুতরাং ডায়াবেটিসের প্রকৃত চিকিৎসা শর্করার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েও করতে হয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তে লিপিড ঠিকমতো বজায় রাখা। এ ক্ষেত্রে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বিশেষ জরুরি। অ্যাসপিরিনের ব্যবহারও রক্তকে তরল রাখতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ১০ : আমি প্রত্যেক রাতে মদ্যপান করি। কারণ কোথাও একটা পড়েছি যে অ্যালকোহল হৃদযন্ত্রকে নিরাপত্তা দেয়। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা কি এটা চালাতে পারবে?
উত্তর : এমন কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই যা থেকে বলা যায় অ্যালকোহল হৃদরোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। যদিও তা রক্তে কিছুটা ‘ভালো’ কোলোস্টেরল বাড়ায় (যা এইচডিএল নামে পরিচিত)। সুতরাং ‘হার্ড ড্রিঙ্কস’ ডায়াবেটিস আছে বা নেই এমন কোনও ব্যক্তির হৃদরোগের সম্ভাবনা কমায় এটা বলা যায় না।
অ্যালকোহলের পরিমাণ বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের অতিরিক্ত জটিলতা বাড়ে। যেমন—
প্রশ্ন ১১ : দেড় বছর আগে শেষ বার আমার চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন, ডায়াবেটিস খুব ভালো ভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখন আমি ভালোই আছি। কোনও সমস্যা অনুভব করছি না। তা হলে কি তাঁকে আবার দেখানোর দরকার আছে?
উত্তর : ডায়াবেটিস কী রকম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আপনাকে মাঝেমাঝেই তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। শুধুমাত্র লক্ষ্মণের উপর নির্ভর করে পরীক্ষা করাবেন কিনা, চিকিৎসকের কাছে যাবেন কিনা—এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। যদিও আপনি এখন সুস্থ বোধ করছেন তবুও সাধারণ নির্দেশিকা হিসাবে নিয়মিত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি করা উচিত
শরীরের ওজন এবং রক্তচাপ |
প্রতি ৩ থেকে ৬ মাসে |
---|---|
পায়ের পাতা পরীক্ষা |
প্রতি ১২ মাসে |
রক্তে শর্করার পরিমাণ |
প্রতি ২ মাসে (যাঁরা ইনসুলিন-নির্ভর চিকিৎসা করছেন তাঁদের ক্ষেত্রে আরও কম সময়ে পরীক্ষা করতে হবে।) |
ব্লাড গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন |
প্রতি ৪ থেকে ৬ মাসে |
ব্লাড ক্রিয়েটানিন, লিপিড প্রোফাইল |
প্রতি ১২ মাসে |
ইউরিন মাইক্রোঅ্যালবুমিন ক্রিয়েটানিন রেশিও |
প্রতি ১২ মাসে (অস্বাভাবিক ফল এলে প্রতি ৬ মাসে ফের পরীক্ষা করতে হবে।) |
প্রশ্ন ১২ : আমি বুঝতে পারছি না কেন আমাকে গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করাতে হবে। আমার তো কোনও দিন রক্তাল্পতা ছিল না।
উত্তর : গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা রক্তাল্পতা মাপার নিরিখ নয়। এর দ্বারা গত তিন মাসে রক্তে শর্করার পরিমাণের গড়পড়তা পরিমাণ জানা যায়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য হল, শর্করার পরিমাণ বেশি থাকলে বুঝতে হবে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে যুক্ত থাকা গ্লুকোজের আনুপাতিক হার বেড়েছে। হিমোগ্লোবিনের বাহক লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল ৩-৪ মাস। গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন তাই গত তিন মাসের রক্তে শর্করার উপস্থিতির ইতিহাস তুলে ধরতে পারে।
আজকের দিনে এটাই রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সেরা দীর্ঘমেয়াদি সূচক। আমাদের লক্ষ্য হবে এটিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা।
প্রশ্ন ১৩ : কত দিন অন্তর আমি রক্তে শর্করার পরিমাণের পরীক্ষা করাব।
উত্তর : এটা আপনার অবস্থার উপর নির্ভর করছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অবস্থা খুবই খারাপ, এ রকম রোগীর ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় পরীক্ষা করতে হতে পারে। সদ্য ধরা পড়া ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অর্থাৎ যাঁদের ইনসুলিন ছাড়া চিকিৎসা হয় না এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের যে সব রোগীর ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে, সকলকেই গোড়ার দিকে কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহ অন্তর রক্তে শর্করার পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষা করার সময় এক দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দেখে নেওয়া দরকার। যে সব রোগী মুখে ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তাঁদের সাধারণত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ অন্তর পরীক্ষা করানো উচিত।
প্রশ্ন ১৪ : কোন সময়ে পরীক্ষা ভাল, খালিপেটে না পোস্ট প্র্যানডিয়াল (পিপি)?
উত্তর : প্রকৃতপক্ষে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে আমাদের দিন-রাতের সব সময়ই রক্তে শর্করার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয়। ফলে দু’টি পরীক্ষার ফলই দরকার। কিন্তু যদি একটি পরীক্ষা করাই সম্ভব হয়, তা হলে খালি পেটের পরীক্ষা শ্রেয়। মনে রাখা দরকার পিপির মূল্যায়ন করতে গেলে কেবলমাত্র মধ্যাহ্নভোজের পর পরীক্ষা করলে হবে না, প্রতিটি মিলের পরেই করাটা জরুরি।
প্রশ্ন ১৫ : পিপি ব্লাড গ্লুকোজ পরীক্ষার আগে কতটা গ্লুকোজ খাবারের সঙ্গে দেহে যাওয়া উচিত?
উত্তর : একবার যখন আপনার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে তখন আর ‘পোস্ট গ্লুকোজ লোড’ পরীক্ষার দরকার পড়ে না।
পিপি পরীক্ষা সাধারণ খাওয়া শুরু করার ২ ঘণ্টা পর করলেই চলবে।
ফলাফলের সঠিক ব্যাখ্যার জন্য খাওয়ার আগে আপনাকে আপনার নির্দিষ্ট ডায়াবেটিস নিরোধক ওষুধও খেতে হবে।
প্রশ্ন ১৬ : স্থানীয় ল্যাবরেটরি বেলা তিনটের আগে রক্তের নমুনা নেয় না। কিন্তু আমার নির্দিষ্ট লাঞ্চের সময় হল দুপুর দু’টো। এ ক্ষেত্রে কী করে আমি পিপি পরীক্ষা করাব?
উত্তর : আপনি ব্রেকফাস্টের পরও পিপি করাতে পারেন। সেটিও পিপি গ্লুকোজ। মধ্যাহ্নভোজের পর বা নৈশভোজের পর বা খুব ভোরে রক্ত পরীক্ষা করতে হলে গ্লুকোমিটার ব্যবহার করে নিজেই পরীক্ষা করে নিতে পারেন।
প্রশ্ন ১৭ : গ্লুকোমিটার কি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য? আমি জীবনে নিজে ছুঁচ ফোটাইনি। সে ক্ষেত্রে কী করে গ্লুকোমিটার ব্যবহার করব?
উত্তর : বর্তমানে বেশ কয়েক ধরনের বিশ্বাসযোগ্য গ্লুকোমিটার পাওয়া যায়। সেগুলি ব্যবহার করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই সহজ। শুধু তা-ই নয়, রক্ত বের করে নেওয়ার পদ্ধতিও প্রায় ব্যথাহীন।
এই মিটারগুলির মেমরিতে আগের বেশ কিছু পরীক্ষার ফল জমা থাকে। এমনকী গড়পড়তা হারও মিটারগুলি থেকে পাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ১৮ : আমি ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আলু বা মাটির তলায় জন্মায় এমন আনাজ খাওয়াও ছেড়েছি। মিষ্টি ফলও খাই না। তা সত্ত্বেও আমার রক্তে শর্করার পরিমাণ এত বেশি কেন?
উত্তর : ডায়াবেটিসে খাদ্যগ্রহণের ধারণার বহু পরিবর্তন এসেছে। গম ও চালের একই পরিমাণ সমান মাপের ক্যালোরি বহন করে। ফলে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে দু’টোর যে কোনও একটা চলতে পারে। অবশ্যই তার জন্য খাওয়াদাওয়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা ছকতে হবে।
ঠিক সে ভাবেই স্টার্চ জাতীয় পদার্থ সমৃদ্ধ খাবার যেমন আলু খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। গমের সমমাপের আলুতে গমের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ ক্যালোরি থাকে। এখন যে কোনও ফল খাওয়ার ব্যাপারেই চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন।(ফাস্ট ফুডের তুলনায় ফল অতি অবশ্যই ভাল।) তবে ভারী চেহারার লোকজনের পক্ষে বেশি পরিমাণ ক্যালোরি রয়েছে এমন ফল যেমন, কলা খেতে চিকিৎসকরা নিষেধ করতে পারেন।)
সুতরাং আজকের দিনে ডায়াবেটিস রোগীরা বিভিন্ন খাবারের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে নিজের খাদ্য তালিকা বানাতে পারেন।
যদি ডায়েট ও নিয়মিত শরীরচর্চা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম না হয় তবে ওষুধের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
প্রশ্ন ১৯ : যে ক্ষেত্রে সারা জীবন ধরে চিকিৎসা করতে হবে সেখানে তেঁতো জাতীয় খাদ্যের কি কোনও আলাদা উপকারী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর : করলা বা নিমের রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর ক্ষেত্রে সামান্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ভাবে শর্করার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে তারা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
প্রশ্ন ২০ : গাছগাছালি থেকে প্রস্তুত পদার্থের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। সারা জীবন চিকিৎসা করাতে হবে এমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের কি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
উত্তর : এতে কোনও সন্দেহ নেই যে ভেষজ ওষুধের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে যা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অ্যালোপ্যাথি মেডিসিনের তুলনায় ভেষজ ওষুধ নিয়ে অনেক কম গবেষণা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করা যেতে পারে যে দীর্ঘকাল ধরে বহু অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করে চিকিৎসা করাটা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে নিরাপদ ও কার্যকর।
প্রশ্ন ২১ : আমার কাকা ইনসুলিন শুরু করার পরে পরেই কিডনি বিকল হয়ে মারা গিয়েছিলেন। আমার রক্তে শর্করার পরিমাণ ট্যাবলেট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিন্তু ইনসুলিন নিতে আমার মন সায় দিচ্ছে না।
উত্তর : এটা আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার কাকা ইনসুলিন চালু করার দরুন মারা যাননি। বরং হয়তো অনেক দেরিতে ইনসুলিন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তাই তাঁর কিডনি বিকল হওয়াটা ত্বরান্বিত হয়েছিল।
ইনসুলিন কখনওই কিডনি বিকল হওয়ার কারণ হতে পারে না। বরং সময়মতো ইনসুলিন শুরু করতে পারলে কিডনি বিকল হওয়াটা প্রতিরোধ করা বা পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। দুঃখজনক ভাবে ইনসুলিনের ব্যবহার নিয়ে সাধারণ মহলে অনেক গুজব চালু রয়েছে। যে কারণে ডায়াবেটিস রয়েছে এমন রোগী দীর্ঘদিন ধরে ইনসুলিন ব্যবহার না করে কাটিয়ে দেন। ফলে ইনসুলিন ব্যবহারের পূর্ণ উপযোগিতা পাওয়ার সময়সীমার অনেক পরে তার ব্যবহার শুরু হয়।
প্রশ্ন ২২ : আমার চিকিৎসক ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকী তিনি আমাকেই নিজের হাতে তা নিতে বলেছেন। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে ইনজেকশন দেওয়ার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় কম্পাউন্ডার, যিনি ইনজেকশন দিতে অভ্যস্ত, তাঁকে ইনসুলিন দেওয়ার জন্য ডাকলে ভাল হয় না?
উত্তর : আপনিই আপনার ইনসুলিন শরীরে ঢোকানোর ব্যাপারে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। এর পর উপযুক্ত হল নিকট আত্মীয়, যেমন স্ত্রী বা স্বামী বা ছেলেমেয়ে। শিশুর ক্ষেত্রে তার বাব-মা। ইনজেকশনের টেকনিক খুবই সোজা। আপনার চিকিৎসক বা তাঁর সহকারী আপনাকে তা শিখিয়ে দেবেন। একবার আপনি ইনজেকশন নেওয়ার ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে দেখবেন এতে কোনও ঝামেলা নেই এবং তা প্রায় ব্যথাহীন। নতুন নতুন ইনজেকশন নেওয়ার যন্ত্র এসেছে। যেমন ‘ইনসুলিন পেন’ পদ্ধতিটা অনেক সুবিধাজনক ও ইনজেকশন নেওয়াও ঝঞ্ঝাটমুক্ত করেছে।
তার উপর আপনি যদি নিজেই ইনজেকশন নিতে অভ্যস্ত হন তা হলে কখন আপনি খাবেন তা আপনার নিজের উপর নির্ভর করবে। কম্পাউন্ডারকে প্রদেয় অর্থও স্বচ্ছন্দে বাঁচাতে পারেন।
মনে রাখবেন বহু কম্পাউন্ডারই ইন্ট্রাম্যাসকুলার ইনজেকশন দিতে অভ্যস্ত, কিন্তু ইনসুলিন নেওয়ার মতো সাবকিউটেনিয়স ইনজেকশন দেওয়ার ব্যাপারে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ভুলে ভরা ইনজেকশন দেওয়ার পদ্ধতি সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। ইনসুলিন ঢোকার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তার উপকারিতা কমাতে পারে বা পরবর্তীকালে ইনজেকশন নেওয়ার জায়গায় দাগ সৃষ্টি করে বিকৃত করে দিতে পারে।
প্রশ্ন ২৩ : আমি এক বছর ধরে ইনসুলিন নিচ্ছি তা সত্ত্বেও আমার রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি। ইনসুলিন কাজ করছে না ভেবে কি তা নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারি?
উত্তর : ইনসুলিন কাজ করছে না এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইনসুলিন কাজ না করার কারণ হল ঠিকমতো ডোজে ঠিক ভাবে নেওয়া হচ্ছে না।
মনে রাখা জরুরি ইনসুলিন শুধু শুরু করলেই কাজ করবে এমনটা নয়। সঠিক ব্লাড গ্লুকোজ মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য ইনসুলিনের ডোজ কয়েক দিন অন্তর পরিবর্তন করতে হয়। সুতরাং বন্ধ না করে আপনাকে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে বারেবারে রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ইনসুলিনের সঠিক ডোজ নির্ণয় করতে হবে।
প্রশ্ন ২৪ : ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের জটিলতার জন্ম দেয় এটা জানতে পেরে আমি খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়েছি। ডায়াবেটিসের চেয়ে বেশি অভিশাপ কি আর কিছু আছে?
উত্তর : চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটু যত্ন ও শৃঙ্খলা এবং তার সঙ্গে নিয়মিত নজরদারি আপনাকে পরিপূর্ণ আনন্দায়ক জীবন দিতে পারে। যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তা হলে আপনি পারবেন না বা লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবেন না এমন কোনও কাজ নেই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ব্যক্তিরা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন। কয়েকটি উদাহরণ, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারক স্বামী বিবেবকানন্দ, বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রাষ্ট্রনায়ক মিখাইল গরবাচভ, অভিনেতা উৎপল দত্ত, অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর, গায়ক এলভিস প্রেসলি, ক্রিকেটার ওয়াসিম আক্রম প্রমুখ। চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাপন সহজ হয়ে আসছে। আজকাল কেউ যদি ডায়াবেটিস সম্পর্কে যথেষ্ট শিক্ষিত হন তবে কোনও রকম পাপবোধ ছাড়াই মিষ্টি খেতে পারেন। (অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে)। তা ছাড়া চিকিৎসার নতুন নতুন উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন প্রত্যঙ্গকে নিরাপত্তা দেওয়ারও ব্যবস্থা হচ্ছে, যেমন ডায়াবেটিসের হাত থেকে কিডনি ও হার্টকে বাঁচানোর উপায়। সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে ডায়াবিটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়। ফলে একে এক প্রকার ছদ্মবেশে আশীর্বাদ বলা যেতে পারে। তাঁরা অন্যদের তুলনায় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেশি দিন বাঁচতে পারেন।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/21/2019
ডায়াবেটিসের বিভিন্ন দিক নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছ...
এই পৃষ্টাতে ডায়াবেটিস কিভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে দৃষ্...
ডায়াবেটিস বা মধুমেহ বা বহুমূত্র রোগ সম্পর্কে নানা ...